ভারতের মুসলমানদের জন্য রমজান: আতঙ্ক আর নির্যাতনের এক অধ্যায়


ক্রাইম জোন ২৪।। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। সাধারণত পবিত্র রমজান মাস মুসলমানদের জন্য আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের সময় হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু ভারতের মুসলমানদের জন্য এই মাসটি এক ভিন্ন বাস্তবতা নিয়ে আসে।
আজানের পাশাপাশি শোনা যায় জনতার চিৎকার, বুলডোজারের গর্জন, এবং জানাজার সুর। কোথাও একজন মুসলমানকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, কোথাও মারধর করা হচ্ছে, কোথাও আবার নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। মসজিদের দরজায় হামলা চালানো হচ্ছে, এমনকি মুসলমানদের বাড়িঘরও গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
প্রতিদিনের খবরের শিরোনামে উঠে আসে মুসলমানদের নিপীড়নের ঘটনা। কোথাও না কোথাও এমন খবর পাওয়া যাবে যেখানে মুসলিমদের জোর করে হিন্দু জাতীয়তাবাদী স্লোগান দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, অথবা বিজেপির কোনো নেতা ইসলামের অনুসারীদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য করছেন, কিংবা কোনো ইফতার মাহফিলে হামলা হচ্ছে।
এমনকি এই ঘটনাগুলোকে এখন স্বাভাবিক হিসেবে দেখা হচ্ছে। একসময় এসব নিয়ে ক্ষোভ, বিতর্ক হতো, রাষ্ট্র কিংবা নাগরিক সমাজ থেকে কিছুটা প্রতিক্রিয়া আসতো। কিন্তু এখন এমন সহিংসতা এতটাই নিয়মিত হয়ে উঠেছে যে এটি যেন জীবনের একটি সাধারণ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই বছর রমজান মাসে হিন্দুদের হোলি উৎসবও ছিল। ভারতের বিভিন্ন শহরে হোলির মিছিলকে মুসলমানদের হয়রানির সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা। অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে—যা শুরু হয় “উদযাপন” হিসেবে, তা শেষ হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।
মহারাষ্ট্রের নাগপুরে এক মুঘল সম্রাটের সমাধি ভেঙে ফেলার দাবিতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে পুলিশসহ বহু মানুষ আহত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৫০ জনেরও বেশি মুসলমানের নামে মামলা করা হয়, অথচ সহিংসতা উস্কে দেওয়া ব্যক্তিরা শাস্তি থেকে রেহাই পায়।
হোলির সময় মুসলমানদের মসজিদ লক্ষ্য করে হামলার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। অনেক জায়গায় মসজিদের প্রবেশপথে রঙ ছিটিয়ে দেওয়া হয়, মুসলমানদের ধর্মীয় স্থানকে অপমান করা হয়। আলীগড় শহরে মসজিদগুলোকে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়, যেন মুসলমানদের বলা হয়—“তোমরা অদৃশ্য থাকো”।
উত্তরপ্রদেশের পুলিশের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট—যদি মুসলমানরা হোলির অংশ হতে না চায়, তবে ঘরের বাইরে বের হওয়া উচিত নয়। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও এই বক্তব্যের সমর্থন করেছেন, যা থেকে স্পষ্ট যে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলমানদের কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে।
ভারতে মুসলমানদের জন্য প্রতিবাদ করাও এখন অপরাধ। গুজরাটে তারাবির নামাজের পর এক সহিংসতার ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলার জন্য এক মুসলমান ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এখন এটাই নিয়ম:
-
মুসলমানদের উপর সহিংসতা চালানো হবে, কিন্তু তারা প্রতিবাদ করতে পারবে না।
-
মুসলমানরা কষ্ট সহ্য করবে, কিন্তু অভিযোগ করতে পারবে না।
-
মুসলমানরা মারা গেলে, রাষ্ট্র কেবল অসহায়ত্ব প্রকাশ করবে।
বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে মুসলমানদের নিয়ে বিদ্রূপ করেন, কিন্তু তারা কোনো শাস্তি পান না। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা রঘুরাজ সিং মুসলমানদের হোলির সময় অস্বস্তি এড়াতে নিজেদের সম্পূর্ণ ঢেকে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপমান।
এটি শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষয় নয়, বরং মুসলমানদের অস্তিত্ব মুছে ফেলার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টার অংশ।
ভারতে মুসলমানদের উপর সংঘটিত প্রতিটি সহিংসতায় একটি সাধারণ চিত্র দেখা যায়:
-
প্রথমে মুসলমানদের উপর হামলা হয়।
-
এরপর তাদেরই অপরাধী বানানো হয়।
-
মুসলমানরা যদি প্রতিবাদ করে, তাহলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়।
যারা মুসলমানদের হয়রানি, হত্যা বা নিপীড়ন চালায়, তাদের কোনো শাস্তি হয় না। বরং তাদের পুরস্কৃত করা হয়।
আজকের ভারতে মুসলমানদের জন্য প্রতিদিনের জীবন এক অগ্নিপরীক্ষা। যে কোনো সময় মসজিদে হামলা হতে পারে, ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে, রোজা রাখাও হতে পারে অপরাধ।
সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, এসব এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আগে উন্মত্ত জনতা মসজিদে হামলা চালালে মানুষ হতবাক হতো, এখন তা কেবল আরেকটি সংবাদ হয়ে গেছে।
ন্যায়বিচার এখন কেবল ক্ষমতাশালীদের জন্য। মুসলমানরা যদি হত্যা হয়, তাহলে তাদের পরিবারকে শাস্তি দেওয়া হয়। মুসলিম নারীরা মুখ খুললে তাদের ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়।
ভারতে মুসলমানদের অস্তিত্বের লড়াই এখন রোজকার বাস্তবতা। হিজাব পরার জন্য হয়রানি করা হচ্ছে, মুসলিম ব্যবসায়ীদের পিটিয়ে এলাকা ছাড়া করা হচ্ছে, মুসলমানদের বাড়ি ভাড়া দিতে মানুষ ভয় পায়।
এই নিপীড়ন শুধু বড় সহিংসতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং মুসলমানদের প্রতিটি পদক্ষেপকে কঠিন করে তোলার জন্য এক সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চলছে।
ভারতের মুসলমানরা এখন আর কারো সহানুভূতির জন্য অপেক্ষা করছে না। তারা রোজা রাখছে, নামাজ পড়ছে, ইফতার করছে—এই প্রতিদিনের কাজগুলোই তাদের প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
তারা জানে, তারা চাইলেও অদৃশ্য হয়ে যেতে পারবে না। রাষ্ট্র যতই চেষ্টা করুক, মুসলমানরা তাদের বিশ্বাস ও পরিচয় ধরে রাখবে। রোজা রাখা, নামাজ পড়া, এবং প্রতিদিন বেঁচে থাকার মধ্য দিয়েই তারা প্রমাণ করছে—তারা পরাজিত হয়নি।
ক্রাইম জোন ২৪