শিরোনাম

ইসরায়েল-ইরান কোন ভবিষ্যতের মুখোমুখি

ইসরায়েল-ইরান কোন ভবিষ্যতের মুখোমুখি

মধ্যপ্রাচ্যে বহুদিন ধরে সঞ্চিত উত্তেজনা অবশেষে বিস্ফোরণের পথে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ছায়াযুদ্ধ এখন সরাসরি সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। যে উত্তেজনা এত দিন প্রক্সি গোষ্ঠী ও সাইবার হামলার মধ্য দিয়ে সীমিত ছিল, তা এখন ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক ও পরমাণুবিজ্ঞানীদের মৃত্যুতে ভয়াবহ এক বাঁক নিয়েছে। এ হামলায় যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের তালিকায় এমন কিছু নাম রয়েছে, যাঁরা ইরানের কৌশলগত কাঠামোর ভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন।

গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ইসরায়েল এমন এক হামলা চালিয়েছে, যা ইরানের সামরিক, গোয়েন্দা ও পরমাণু অবকাঠামোর হৃৎপিণ্ডে একসঙ্গে আঘাত হেনেছে। ইরানের সেনাপ্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, আইআরজিসির প্রধান হোসেইন সালামি, ক্ষেপণাস্ত্র কমান্ডার আমির আলী হাজিজাদেহ, জেনারেল গোলামালি রাশিদ—এসব ব্যক্তি শুধু পদমর্যাদার কারণে নয়, বাস্তবে ইরানের সামরিক প্রতিরোধ কাঠামোর স্থপতি ছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফেরেইদুন আব্বাসি, মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি, আবদুল হামিদ মিনুচেহর, আমির হোসেইন ফাঘিহি, মোতাল্লেবজাদেহ প্রমুখ নাম, যাঁরা ইরানের পরমাণু কর্মসূচির অগ্রগতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন।

এই হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তেহরানের রাস্তায় মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। শহীদদের ছবি হাতে নিয়ে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি প্রতিজ্ঞা করেন, এই হামলার জবাব এমন হবে, যা ইসরায়েলের অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে দেবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের হারানোর কিছু নেই, আমাদের প্রতিশোধ ইতিহাসে লেখা থাকবে।’

এই মুহূর্তে যুদ্ধের দামামা যেন স্পষ্টতই শোনা যাচ্ছে। কয়েক মাস ধরে সংঘটিত কিছু ঘটনা এই যুদ্ধের আভাস আগেই দিয়েছিল। সিরিয়ায় ইরানঘনিষ্ঠ সামরিক ঘাঁটিতে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ, গাজার যুদ্ধ থেকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়া, হিজবুল্লাহ ও হুতিদের সক্রিয়তা—সবই যেন এই ঘটনার ভিত্তি প্রস্তুত করছিল। কিন্তু এবারের হামলা সরাসরি ইরানের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে।

ইসরায়েলের এই কৌশল স্পষ্ট—ইরান যেন পারমাণবিক বোমা তৈরির পথে এগোতে না পারে এবং আঞ্চলিকভাবে তার প্রভাব খর্ব হয়। তেল আবিবের দৃষ্টিতে, পারমাণবিক অস্ত্রধারী একটি ইসলামিক রিপাবলিক শুধু ইসরায়েলের অস্তিত্ব নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতি ও পশ্চিমা স্বার্থের জন্য হুমকি। তাই তারা মনে করে, সময়মতো আগাম হামলা চালানোই নিরাপত্তার একমাত্র নিশ্চয়তা।

অন্যদিকে ইরানের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তারা নিজেদের রক্ষা, আঞ্চলিক প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন এবং মুসলিম ভূমি রক্ষার ন্যায্য দাবি হিসেবে প্রতিরক্ষা শক্তি গড়ে তুলেছে বলে মনে করে। ফলে এই সংঘর্ষ একদিকে কৌশলগত, আবার অন্যদিকে আদর্শগত। এই আঘাত তাই শুধু ব্যক্তিকে নয়, একটি আদর্শকেও লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে বলে ইরানের অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঘটনার পর কী হতে পারে?

প্রথমত, ইরানের বদলা আসবে—তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই সামরিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে, বিশেষ কমান্ড ইউনিটগুলো মোতায়েন করা হয়েছে হরমুজ প্রণালি ঘিরে। হিজবুল্লাহ ও হুতিদের সক্রিয়তা বেড়েছে। হামাস ও ইসলামিক জিহাদ বাহিনী ইসরায়েলি বেসামরিক এলাকা লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালিয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটিগুলোও হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, যদি ইরান সরাসরি তেল আবিব, হাইফা কিংবা ডিমোনা পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়, তা হলে এই যুদ্ধ পুরোপুরি সরাসরি যুদ্ধ হয়ে উঠবে। তখন ইসরায়েলও ইরানকে লক্ষ্য করে পূর্ণমাত্রার হামলা চালাবে, যার মধ্যে থাকতে পারে পারমাণবিক অস্ত্রের মারণ আঘাতও। এই মুহূর্তে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা কেউ খোলাখুলি বলছে না, কিন্তু উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনী ও বিমানবাহী রণতরি মোতায়েন ইঙ্গিত দিচ্ছে, পরিস্থিতি ভয়াবহ দিকে যাচ্ছে।

তৃতীয়ত, এই সংঘাত যদি তীব্রতর হয়, তাহলে তেল ও গ্যাসের সরবরাহ চরমভাবে ব্যাহত হবে। হরমুজ প্রণালি বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ জ্বালানি পরিবহনের পথ। যদি ইরান সেটি সাময়িক বন্ধ করে দেয়, তাহলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ১৫০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এতে করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মতো আমদানিনির্ভর দেশগুলোর অর্থনীতি চরম চাপে পড়বে।

চতুর্থত, মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া এই মুহূর্তে চিত্রনাট্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইসরায়েলের এমন দুঃসাহসিক হামলার নিন্দা করে তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান বিবৃতি দিয়েছে। সৌদি আরব সরাসরি বিবৃতি না দিলেও আরব লিগের মাধ্যমে উদ্বেগ জানিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন—যারা ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে—তাদের অবস্থান এখন গভীর চাপের মুখে। ইরান তাদের কাছে দায় চাইছে।

পঞ্চমত, যুক্তরাষ্ট্র এক ভয়াবহ দোটানায় পড়ে গেছে। একদিকে ইসরায়েল তার দীর্ঘদিনের মিত্র, অন্যদিকে ইরানকে চাপে রাখতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি হুমকির মধ্যে পড়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন একদিকে মধ্যস্থতার ভাষায় কথা বলছে, অন্যদিকে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ সমর্থন করছে। এর ফলে আমেরিকার অবস্থান বিতর্কিত হয়ে উঠছে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, এবারের ইসরায়েলি হামলা একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। কেবল একটি প্রতিশোধ নয়, এটি একটি প্রজন্মের স্বপ্ন, কৌশল, ও আত্মপরিচয়ের ওপর আঘাত। ইরান এই আঘাতের জবাবে কঠিন পাল্টা হামলা চালালে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, তখন পুরো মধ্যপ্রাচ্য এমন এক অস্থিরতার মধ্যে প্রবেশ করবে, যেখানে কেউ বিজয়ী হবে না।

এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক কূটনীতি, জাতিসংঘ, ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ওপর দায়িত্ব এসে পড়ে—তারা কি এই সংঘর্ষকে একটি নিয়ন্ত্রিত বিন্দুর মধ্যে রাখতে পারবে? নাকি ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বিশ্ব, যার শিরোনাম হবে ‘পারস্য বনাম ইসরায়েল’?

এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে আগামী কয়েক দিনের উত্তপ্ত ঘটনাপ্রবাহের ওপর, আর বিশ্বের দৃষ্টি এখন সেদিকেই নিবদ্ধ। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়—তা শুধু শোক, ধ্বংস, আর অসমাপ্ত প্রতিশোধের ইতিহাস সৃষ্টি করে। তবু মানুষ বারবার সেই ভুলেই পা বাড়ায়। আমরা শুধু আশা করতে পারি, এবার সেই ভুলের চক্র থেকে বেরিয়ে আসবে বিশ্ব, নতুবা সামনে অপেক্ষা করছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।



আরও দেখান
Back to top button