পেয়ারা খাতে ২০ হাজার পরিবার


বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলার সীমান্তবর্তী ২৬টি গ্রামে প্রায় ৩১ হাজার একর জমিতে বিস্তৃতি পেয়েছে পেয়ারাবাগান। এই পেয়ারা উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত প্রায় ২০ হাজার পরিবার। বরিশালের বানারীপাড়া পেয়ারা চাষে প্রসিদ্ধ হলেও ঝালকাঠির ভিমরুলী গ্রামে ঐতিহ্যবাহী ভাসমান হাট এই অঞ্চলের কৃষি, ব্যবসা ও পর্যটনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
জেলা শহর থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে ভিমরুলীর খালে প্রতিদিন বসে ব্যতিক্রমী ভাসমান হাট। শত শত নৌকায় টসটসে পেয়ারা নিয়ে হাজির হন চাষিরা। এই হাট শুধু একটি কৃষিপণ্য বেচাকেনার স্থান নয়, বরং দুই শতাব্দীর কৃষি ঐতিহ্যের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
যথাযথ পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে এই হাট আন্তর্জাতিক পর্যটন ও কৃষি অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে বলে মনে করছেন এই পেশার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, খালজুড়ে পেয়ারাবোঝাই শত শত নৌকা থেমে থেমে চলছে। মনে হয় যেন প্রকৃতি নিজে এক চলমান হাটের আয়োজন করেছে। সকাল থেকে বিকেল, কখনো বৃষ্টির ঝিরিঝিরি ধারা, কখনো রোদের ঝিলিক, সবকিছু ছাপিয়ে চলে প্রাণচঞ্চল লেনদেন।
জানা গেছে, ঝালকাঠি সদর উপজেলার ভিমরুলী, খাজুরা, ডুমুরিয়া, বৈরামপুর, জগদীশপুর, গৈহার, মিরকাঠি, কাফুরকাঠি, নবগ্রাম ও শতদশকাঠিসহ বহু গ্রামের মানুষের জীবিকা পেয়ারা চাষের ওপর নির্ভরশীল।
কীর্তিনাশা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ভবেন্দ্রনাথ হালদার বলেন, ‘এই হাট আমাদের আবেগ ও ইতিহাস বহন করে। পূর্ব বাংলার নদীপথে পণ্য চলাচল থেকে এর সূচনা।’
প্রবীণ চাষি রমেশ চন্দ্র হালদার স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থেকে এই হাট চলছে। তখন কল্পনাও করিনি, এখন এত দূর থেকে লোকজন আসবে এটা দেখতে।’
জানা গেছে, পেয়ারাগাছ থেকে ফল সংগ্রহ শুরু হয় জুন-জুলাইয়ে। তখন পুরো এলাকা ভরে ওঠে পাকা পেয়ারার মিষ্টি গন্ধে। তবে চলতি মৌসুমে অনিয়মিত আবহাওয়ার কারণে পেয়ারা উৎপাদন কিছুটা কমেছে। ঝালকাঠি কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, গত বছর জেলায় ৫৬২ হেক্টর জমিতে ৫ হাজার ৬২৬ টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়েছিল।
স্থানীয় চাষি গৌতম হালদার বলেন, ‘এ বছর সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় ফুল ঝরে গিয়েছিল। ফলন কমেছে ঠিকই, তবে বাজারে চাহিদা বেশি থাকায় এবার দাম ভালো পাচ্ছি। গত বছর প্রতি মণ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বিক্রি হলেও এবার তা ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’
আড়তদার সঞ্চয় হালদার বলেন, পেয়ারার চাহিদা অনেক, কিন্তু সরবরাহ কম থাকায় পাইকারেরা লোকসানে পড়ছেন।
বর্ষাকালে ভিমরুলীর হাট হয়ে ওঠে ভ্রমণপিপাসুদের স্বর্গ। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে আসা পর্যটক শামীমা তাসনিম বলেন, ‘নৌকায় বসে পেয়ারার হাট দেখা, পছন্দ করে কিনে খাওয়া, এটা দারুণ অভিজ্ঞতা।’
ভিমরুলীর খাল ও আশপাশের পেয়ারাবাগান ঘিরে গড়ে উঠেছে ইকো ট্যুরিজম। কুড়িয়ানা এলাকার ‘পেয়ারা পার্ক পিকনিক স্পট অ্যান্ড ইকো কটেজ’-এ প্রতিদিন পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা আলী আহম্মদ বলেন, পেয়ারা প্রক্রিয়াজাতকরণে (জ্যাম, জেলি, চাটনি, জুস) চাষিদের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। নারীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন নারী উদ্যোক্তা ঘরোয়া পরিবেশে পেয়ারা থেকে আচার ও জেলি তৈরি করে বাজারজাত করছেন, যা তাঁদের আয়ের পাশাপাশি অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে।
ঝালকাঠি সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, ভিমরুলীর ভাসমান হাট ঘিরে একটি পর্যটন জোন গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এটা কৃষি ও পর্যটনের মডেল হিসেবে গড়ে তোলা হবে হবে।
ঝালকাঠি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল-মামুন আজকের পত্রিকাকে বলেন, এ বছর জেলায় ৫৬২ হেক্টর জমিতে পেয়ারার আবাদ হয়েছে। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়া এবং তাপপ্রবাহের কারণে ফলন কমেছে। তবে দাম ভালো পাচ্ছেন চাষিরা।