মসলায় স্বাবলম্বী পাহাড়ি কৃষক


ঘামে ভেজা হাতে ঘ্রাণের বিপ্লব শুরু হয়েছে পাহাড়ে। একসময়ের জুমচাষ সেখানে এখন ইতিহাস। সেই জায়গা দখল নিচ্ছে এলাচি, দারুচিনি, আদা, গোলমরিচের মতো দামি মসলা। বাড়ছে জমি, বাড়ছে ফলন, বাড়ছে লাভও। নারীরাও নেমে এসেছেন মাঠে, গড়ে উঠছে প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র। একদিন যা ছিল শুধু খাদ্য, এখন তা হয়ে উঠছে অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত। পাহাড়ি এই ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে শুধু হাটবাজারে নয়, ছুঁয়ে যাচ্ছে রপ্তানির স্বপ্নও।
এই ঘ্রাণের পেছনে রয়েছে বড় একটা চাহিদার গল্প। বাংলাদেশে বছরে মসলার চাহিদা প্রায় ৫৯ লাখ টন, কিন্তু দেশের উৎপাদন এখনো সীমিত। ফলে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। সেই চক্র ভাঙতে পাহাড়ি কৃষকেরা নেমেছেন মাঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি ও জলবায়ু যেহেতু মসলার জন্য আদর্শ; তাই আদা, হলুদ, এলাচ, দারুচিনি, তেজপাতা, গোলমরিচসহ দামি মসলার চাষ সেখানে দ্রুত বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে স্বপ্নও।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে যেখানে পার্বত্য এলাকায় মসলা চাষের জমি ছিল ১ হাজার ২০০ হেক্টর, তা ২০২৫ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫০ হেক্টরে। আদা চাষ বেড়েছে দ্বিগুণ, আর হলুদের চাষ বেড়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ।
বান্দরবান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এম এম শাহ্ নেয়াজ আজকের পত্রিকাকে বলেন, পার্বত্য এলাকায় ২০২১ সাল থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ হওয়া এলাচি ও দারুচিনির ফল খুবই আশাব্যঞ্জক। এখন এটি শুধু বিকল্প চাষ নয়, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের শক্তিশালী উপায় হয়ে উঠেছে। কৃষি অফিস বলছে, স্থানীয় নারীরাও এই খাতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, যা তৈরি করছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয় ধরনের পরিবর্তন।
জুমচাষের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে এখন পাহাড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে গোলমরিচ, তেজপাতা, বিলাতি ধনিয়া, জিরা ও অন্যান্য মসলার চাষ। কৃষকেরা বলছেন, পাহাড়ি জমিতে এসব ফসলের ফলন যেমন ভালো, তেমনি বাজারমূল্য বেশি। এর ফলে স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভবিষ্যতে রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
বান্দরবান সদরের জামছড়ি ইউনিয়নের কৃষক রতন তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘আগে ধান আর কলা চাষ করতাম। এখন সাড়ে তিন একরে আদা, এলাচি আর হলুদের চাষ করি। ভালো লাভ হয়।’ রেশমা চাকমা নামের আরেকজন বলেন, ‘আগে শুধু বাড়ির কাজ করতাম। এখন মাঠে কাজ করি, প্রক্রিয়াজাত করি, বিক্রিও করি। নিজস্ব আয়ের পথ তৈরি হয়েছে।’
বাংলাদেশ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ৫৮.৫০ লাখ টন মসলার চাহিদা রয়েছে, যার মধ্যে আমদানি হয় ৪৪.৯৬ লাখ টন। ভারত, চীন, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আসে এসব মসলা। অথচ বাংলাদেশের নিজস্ব উৎপাদন বাড়লে এই চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ সম্ভব। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০২৪ সালের মধ্যে পাহাড়ি তিন জেলায় যে পরিমাণ এলাচি ও হলুদ উৎপাদিত হয়েছে, তা দিয়ে অন্তত ৩০ শতাংশ আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এক বছরে মসলা আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। কৃষি গবেষকদের মতে, পরিকল্পিত সম্প্রসারণ হলে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব। মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক রাসেল আহমেদ বলেন, ‘হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমরা কৃষকদের বোঝাতে পেরেছি যে জমি ও শ্রম একই থাকলেও মসলার চাষে লাভ অনেক বেশি।’
বাংলাদেশ পাইকারি গরমমসলা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি এনায়েতুল্লাহ বলেন, দেশে মসলা উৎপাদন বাড়লে আমদানির ওপর চাপ কমবে। বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচবে। কারণ, মসলা প্রতিদিনের দরকারি পণ্য।
তবে বাজার ও সরবরাহব্যবস্থায় এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে; বিশেষ করে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সড়ক অবকাঠামোর দুর্বলতার কারণে কৃষকেরা পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। রাঙামাটির বরকল উপজেলার ব্যবসায়ী মাইন উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এলাচি ও হলুদ কিনে চট্টগ্রামে পাঠাই; কিন্তু রাস্তা খারাপ থাকায় পণ্য নষ্ট হয়। সঠিক দাম পাই না।’
তবু আশার খবর হলো, বান্দরবান ও রাঙামাটিতে মসলা শুকানোর ইউনিট ও সংরক্ষণাগার নির্মাণ শুরু হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ১০০ কোটি টাকার মসলা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অর্গানিক হলুদ, আদা ও দারুচিনির চাহিদা তৈরি হয়েছে।
বান্দরবান হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক লিটন দেবনাথের মতে, ‘মসলা চাষের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন সম্ভব। তবে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানির মধ্যে সমন্বয় অপরিহার্য।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রশিক্ষিত জনবল, মান নিয়ন্ত্রণ ল্যাব এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা গেলে ‘পাহাড়ি মসলা’ হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের নতুন ব্র্যান্ড পরিচয়, বিশ্বের বাজারে ছড়াতে পারে ঘ্রাণ আর সম্ভাবনার বার্তা।