শিরোনাম

বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিজয়ের উচ্ছ্বাস

বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিজয়ের উচ্ছ্বাস

মেঘে ঢাকা আকাশ। থেমে থেমে বৃষ্টি। দিনভর এমন অস্বস্তিকর আবহাওয়ায়ও আটকে থাকেনি ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস ২০২৫’ উদ্‌যাপন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ‘জুলাই পুনর্জাগরণ অনুষ্ঠানমালা’য় গতকাল মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে মানুষের ঢল নামে। শিল্পীদের পরিবেশনার পাশাপাশি ফ্যাসিস্টের পলায়ন ক্ষণ উদ্‌যাপন এবং জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রে। শাহবাগে স্থাপিত হয়েছে জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হয় আনন্দে-উচ্ছ্বাসে।

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সকাল থেকেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে জমায়েত হয় ছাত্র-জনতা। কারও মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা, কেউ আবার নিয়েছে হাতে। বৃষ্টির জন্য এক ঘণ্টা পিছিয়ে দুপুর ১২টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়। সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আয়োজন। তারা গেয়ে শোনায় ‘এ দেশ আমার বাংলাদেশ’, ‘আয় তারুণ্য আয়’ সম্মেলক গান। সাইমুমের শিল্পী ওবায়দুল্লাহ তারেক শোনান ‘ওমা আর কেঁদো না’, মশিউর রহমান শোনান ‘যাদের জন্য পেলাম আবার নতুন বাংলাদেশ’। শেষে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে নিয়ে জারি গান দিয়ে শেষ হয় তাদের পরিবেশনা।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসমুদ্রে পরিণত হয় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। একে একে মঞ্চে আসে কলরব শিল্পীগোষ্ঠী, শিল্পী নাহিদ ও তাশফি। তাঁরা নিজেদের ও দেশের গানে মুগ্ধ করেন ছাত্র-জনতাকে। গানের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। বিজয়ের বর্ষপূর্তিকে রাঙিয়ে তুলতে অনেকেই পরিবারসহ এসেছেন।

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট ঠিক ২টা ২৫ মিনিটে দেশ ছেড়েছিলেন শেখ হাসিনা। সেই পলায়ন ক্ষণকে ফুটিয়ে তুলতে কৃত্রিম হেলিকপ্টারের বেলুন উড়িয়ে দেওয়া হয়। জনতার হাতে দেওয়া হয় ফ্লেয়ার। ফ্লেয়ার থেকে লাল ও সবুজ ধোঁয়া উড়ছে। ওপরে উড়ে যাচ্ছে বেলুনের হেলিকপ্টার। এক অন্য রকম দৃশ্যের অবতারণা হয়।

পরে মঞ্চে ওঠে চিটাগং হিপহপ হুড, র‍্যাপার সেজান, ব্যান্ড দল শূন্য, কণ্ঠশিল্পী ইথুন বাবু ও মৌসুমী। বিকেল ৫টার পরে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সিনিয়র সচিব, বিভিন্ন বাহিনী ও দপ্তর-সংস্থার প্রধান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, সুশীল সমাজ ও ছাত্র প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ঐতিহাসিক জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রথমেই দেখানো হয় জুলাই যোদ্ধা মাহাবুবুলের ওপরে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্র। প্রারম্ভিক বক্তব্য দেন শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী। তিনি বলেন, ‘দেশের ভবিষ্যৎ যখন সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল, সামনে কোনো আলোর দিশারি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন এই সফল গণ-অভ্যুত্থানই আমাদের আবার নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখাল। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে আমরা যেন কিছুতেই লক্ষ্যচ্যুত না হই।’

এরপরে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঘোষণাপত্র পাঠের পরে আবার শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে মঞ্চে আসেন শিল্পী সায়ান, ব্যান্ড সোলস, ওয়ারফেজ, বেসিক গিটার লার্নিং স্কুল, ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ব্যান্ড এফ মাইনর, কণ্ঠশিল্পী পারশা মাহজাবিন, কণ্ঠশিল্পী এলিটা করিম এবং আর্টসেল। পুরো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যান্ড ও দলের ২৫০ জনের অধিক শিল্পী অংশ নেন। সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় স্পেশাল ড্রোন ড্রামা শো ‘ডু ইউ মিস মি?’। পুরো অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন জুলহাজ্জ জুবায়ের ও সারা আলম।

দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। সংসদ ভবনের সামনের সড়কে প্রবেশ করার মুখে ও সংসদ ভবন এলাকায় পুলিশ, র‍্যাব, সেনাবাহিনী, বিজিবির টহলসহ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নজরদারি রাখেন। দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় ফায়ার সার্ভিস ও আনসার সদস্যদেরও। নিরাপত্তার বিষয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার ইবনে মিজান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশ, র‍্যাবসহ সেনাবাহিনী, বিজিবির টহল রয়েছে। উচ্চ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

মূল মঞ্চ ছাড়াও পুরো অ্যাভিনিউতে বসানো হয় চারটি বড় স্ক্রিন। সংসদ ভবনের মূল ফটকের পাশে ছিল লাইভ স্ক্রিন ও গেম শো স্টল। ‘হাসিনা পালায় না’ এমন প্রতীকী খেলার আয়োজনও ছিল। স্ক্রিনে ভার্চুয়াল শেখ হাসিনার দৌড়ানোর খেলায় ধাওয়া করে অংশ নেয় অনেকে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে রাখা হয় পানির ব্যবস্থা। পুরো অনুষ্ঠান সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সহযোগিতায় এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত হয়।

‘হেলিকপ্টার বেলুন’ ওড়াতে গিয়ে বিস্ফোরণে দগ্ধ ১১ জন

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট হেলিকপ্টারে করে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ক্ষণকে তুলে ধরতে হেলিকপ্টার আকৃতির শতাধিক বেলুন ওড়ানো হয়। জনতার হাতে দেওয়া হয় ফ্লেয়ার। ফ্লেয়ারের আগুন বেলুনে থাকা গ্যাসের সংস্পর্শে এলে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ১১ জন দগ্ধ হয়েছে। তাদের গায়ের কিছু অংশ দগ্ধ হয়েছে। তাদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। আয়োজনের স্পিকারের তারেও আগুন লাগে। পরে ড্রোনের পাখার বাতাসে আগুন নিভিয়ে দেওয়া হয়। দগ্ধদের উদ্ধার করে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান জানান, দুপুরে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে দগ্ধ ১১ জন বার্ন ইনস্টিটিউটে এসেছেন। তাঁদের সবার হাত ও মুখ সামান্য দগ্ধ হয়েছে। কারও অবস্থা গুরুতর নয়। সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

আরও যা ছিল রাজধানী ও দেশজুড়ে

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের অনুষ্ঠান ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বছরপূর্তি এবং ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস ২০২৫’ পালন করে। রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে স্থাপন করা হয়েছে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। দিনটি উপলক্ষে মঙ্গলবার দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় একটি স্মারক ডাকটিকিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর অবমুক্ত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ ছাড়া গণভবনে নির্মাণাধীন ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’-এর নির্মাণকাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেন প্রধান উপদেষ্টা। জাদুঘরটি ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট, সংগ্রাম, শহীদ এবং বিজয়ের স্মারক হিসেবে নির্মাণাধীন। নির্মাণ এলাকায় পৌঁছে প্রধান উপদেষ্টা সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, স্থপতি এবং কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং দ্রুততম সময়ে কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিভিন্ন মোটিফ নিয়ে বিজয় শোভাযাত্রা করে বাংলাদেশি চারুশিল্পী সংসদ। মহাখালীতে ‘সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যবৃন্দ-ছাত্র-জনতার ঐক্য শোভাযাত্রা’ বের হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের শিক্ষকেরা শোভাযাত্রা বের করেন, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বের করা হয় শোভাযাত্রা, খুলনায় ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশ ও খুলনা সাইক্লিং কমিটির আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় সাইকেল শোভাযাত্রা। রাজবাড়ীতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ আবদুল গণির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান জুলাই শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধারা।



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button