আলোর মুখ দেখছে না বঙ্গবন্ধু মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র


স্বপ্ন দেখানো ‘বঙ্গবন্ধু মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র প্রকল্প’ নিজেই আলোর মুখ দেখছে না। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া প্রকল্পটি পরিকল্পনায় ঘাটতি ও অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আড়াই বছরে প্রকল্পের ভৌতিক কাজ হয়েছে ১৫ শতাংশ, আর্থিক কাজ মাত্র ৪ শতাংশ। ইতিমধ্যে এই উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ হওয়া ৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা গচ্চা যাচ্ছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিকল্পনার ঘাটতি, কারিগরি অযোগ্যতা ও বাস্তবতা বিবেচনায় সরকার প্রকল্পটি অসমাপ্ত রেখেই শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সচিব ড. কাইয়ুম আরা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত সব পক্ষ প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রকল্পের কাজ আর এগোবে না।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর বিভাগের আওতাধীন আড়াই বছর মেয়াদি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্র’ অনুমোদন দেওয়া হয়। ফরিদপুরের ভাঙ্গায় এই অবলোকন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২১৩ কোটি ৩৮ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের জুলাইয়ে। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। তবে এই আড়াই বছরে প্রকল্পের আর্থিক কাজ হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ১২ শতাংশ, ভৌতিক কাজ হয়েছে ১৫ শতাংশ। ইতিমধ্যে প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
সূত্রমতে, ২০২০ সালের ২১ জুন প্রকল্পটি নেওয়া হয় কর্কটক্রান্তি রেখা ও ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার সংযোগস্থল হিসাব করে। পরে দেখা যায়, কর্কটক্রান্তি রেখা ও ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমা রেখার ছেদবিন্দুটি প্রতিবছর ১৫ মিটার করে চার বছরে ৬০ মিটার দক্ষিণে সরে গেছে। ফলে প্রকল্পটি গুরুত্ব হারায়। সম্প্রতি মূল্যায়ন কমিটির সভায় দেশের প্রথম এই মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র প্রকল্প অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্ত ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) উপপ্রধান মেহেদী হাসান বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনটি যথাযথভাবে হয়নি, ব্যয়ের হিসাবেও অসামঞ্জস্য আছে। ডিজিটাল উপকরণ, সরবরাহ খাত ও মেরামত কোডে অনুমোদনের চেয়ে বেশি খরচ হওয়ায় ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের তথ্য মতে, স্থাপত্য নকশা অনুযায়ী প্রকল্পে নির্মীয়মাণ মহাকাশ অবলোকন কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের ডোম ভূমি থেকে প্রায় ১৭২ ফুট উচ্চতায় স্থাপিত হওয়ার কথা। এ কারণে এটি সম্পূর্ণ নিশ্চল রাখা দুরূহ হবে।
টাওয়ার নিশ্চল করার উপায় হিসেবে ভিত্তিমূল দৃঢ় করা হলে প্রকল্পের ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে, যা কারিগরি ও আর্থিক দিক থেকে কখনোই উপযোগী হবে না। প্রকল্প এলাকায় কৃত্রিম আলোর উপস্থিতি ও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাতাসের আর্দ্রতার আধিক্য থাকায় পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে টেলিস্কোপের মাধ্যমে প্রাপ্ত উপাত্ত মহাকাশ গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্য ততটা উপযোগী হবে না। তাই প্রকল্পটি সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়, জনস্বার্থমূলকও নয়। এমন প্রকল্প কীভাবে গ্রহণ হলো, সেটি তদন্ত হওয়া উচিত।’ আইএমইডির পক্ষ থেকে তিনি প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন।
পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, এ ধরনের প্রকল্প ভবিষ্যতে গ্রহণের আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর আরও সচেতনতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা ১০ একর জমির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পের জন্য কেনা যন্ত্রপাতি জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে জমা দিতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে কারিগরি জ্ঞান এবং অগ্রিম মূল্যায়নের ঘাটতিও উঠে এসেছে সুপারিশে।
প্রকল্প পরিচালক খোকন কান্তি সাহা বলেন, মহাকাশ গবেষণার মতো উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা না থাকায় কাজ এগোয়নি। ডোম টাওয়ারের উচ্চতা, টেকসই স্থাপত্য, কৃত্রিম আলো ও আর্দ্রতার কারণে পর্যবেক্ষণ উপযোগিতা হারিয়েছে প্রকল্পটি। এমনকি ভৌগোলিক কারণে যেখানে সূর্য-অবস্থান পর্যবেক্ষণ হওয়ার কথা, সেই পয়েন্টও প্রতিবছর দক্ষিণে সরে যাচ্ছে।