শিরোনাম

এক বোহিমিয়ান শিল্পী

এক বোহিমিয়ান শিল্পী

একজন শিল্পী সারা জীবন কেবল পালিয়েই বেড়ালেন। খ্যাতি, যশ, অর্থ এমনকি সংসারজীবন থেকে পালিয়ে হয়ে উঠলেন বোহিমিয়ান। শিল্প সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় এক অদ্ভুত আধ্যাত্মিক চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন শিল্পী এস এম সুলতান। বেঁচে থাকলে তিনি হতেন শতবর্ষী। তিনি নেই; কিন্তু তাঁর শিল্প, জীবনের অদ্ভুত যাপন বেঁচে আছে, থাকবে আরও বহুকাল। আজ তাঁর ১০১তম জন্মবার্ষিকী।

সুলতান কি এসব জন্মদিনের খোঁজ রাখতেন? তথাকথিত নাগরিক জীবনকে থোড়াই কেয়ার করে গড়ে নিয়েছিলেন নিজের পৃথিবী। তাঁকে নিয়ে লেখায় কিংবা চলচ্চিত্রে সেই ছবির দেখা মেলে। নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘আদম সুরত’ প্রামাণ্যচিত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কবি শামসুর রাহমান ‘সুলতান তাঁর সালতানাত ত্যাগ করেননি’ প্রবন্ধে যে বাড়ির পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে, ‘সুলতানের সেই লতাগুল্ম এবং গাছপালা ভরা, কালের ক্ষতচিহ্ন বহনকারী বাড়ি অনেকের স্মৃতিতেই ভাস্বর হয়ে আছে। আমরা যারা যাইনি নানা পন্থায় সেই ভবনে, তাদেরও কল্পনায় জাগ্রত তার পরিবেশ, অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রকোষ্ঠ।’

সংসারবিবাগী শিল্পরসিক এই মানুষের বাস জঙ্গলঘেঁষা এক পুরোনো দালানে। সঙ্গী হনুমান, বিড়াল, নেড়ি কুকুর, একপাল মুরগি। তথাকথিত মানুষের সঙ্গে নয়, প্রকৃতির সঙ্গেই যেন মিশে ছিলেন তিনি। সুলতানের ছবি তুলেছিলেন আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন।

সুলতানের সান্নিধ্যে তাঁর থাকার সুযোগ হয়েছিল বেশ। এক সাক্ষাৎকারে সুলতানের সেই বাড়ি নিয়ে নাসির আলী মামুন স্মৃতিচারণা করলেন এভাবে, ‘উনার নিজের থাকার যে রুম, তাতে ছোট্ট একটা চৌকি। চৌকির মধ্যে একটা চাটাই। চাটাইয়ের ওপরে থাকা একটা কাঁথা। ওইটার মধ্যে ঘুমায়, শতচ্ছিন্ন কাঁথা। নিজের ঘুমানোর জায়গার কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়লাম। মাথায় তখন এটাও ঘুরছে, সুলতান একজন সেলিব্রিটি, এস এম সুলতান, গ্রেটম্যান—তাঁর এই অবস্থা! খালি দেখতেছি আর অস্থির হয়ে যাচ্ছি।’

নাগরিক চোখে সুলতানের জীবন দেখে স্বস্তি মেলে না। কারণ, তিনি সাধারণ থেকে অসাধারণের পথ ধরেছেন, যেখানে শিল্পী হিসেবে সাধারণের জীবনকে পরিত্যাগ করেছেন। জীবনযাপনে বিলাস পরিত্যাগ করলেও মনে-মানসে সুলতান ছিলেন অনন্য। তার প্রমাণ মেলে কবি জসীম উদ্‌দীনের ‘হলদে পরীর দেশে’ লেখায়। পাকিস্তানে থাকাকালীন এই শিল্পীর মনের উদার জমিন কবি এঁকেছেন এভাবে, ‘সুলতানের এখনো নৈশভোজ হয় নাই। একটি যুবক বাহিরের দোকান হইতে ১০-১২ খানা চাপাতি (রুটি) ও সামান্য কিছু তরকারি শালপাতায় করিয়া আনিয়া দিল। চার পাঁচজন যুবক আর এই শিল্পীকে (উপস্থিত সেতারবাদক) সঙ্গে লইয়া সুলতান আহার করিল। পরিচয় লইয়া জানিলাম, এই যুবকেরা বেকার অবস্থায় সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো কোনো গ্রাম হইতে করাচি আসিয়াছে চাকরির অনুসন্ধানে। সুলতান তাহাদিগকে আশ্রয় দিয়াছে। মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, যাহার নিজেরই আশ্রয় নাই, সে-ই বোধ হয় এমন করিয়া অপরকে আশ্রয় দিতে পারে। এই করাচি শহরে কত ধনী ব্যক্তি আছে, তাহাদের কতজনের অন্তর সুলতানের মতো এমন করিয়া পরের জন্য কাঁদে?’

কেবল শিল্পী হওয়ার পরে নয়, ১৯২৪ সালে কৃষক ও রাজমিস্ত্রি বাবার ঘরে যে লালমিয়ার জন্ম, শৈশব থেকেই পালিয়ে বেড়াতেন। জন্মস্থান নড়াইল থেকে পালিয়ে কলকাতা, সেখানে আর্ট কলেজ থেকেও পালালেন। ঘুরলেন পুরো ভারত। ভাবনাহীন, দায়িত্বহীন, ভবঘুরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাল। সৈনিকদের ছবি এঁকে পকেট খরচ মেটাচ্ছেন। দেশভাগের পরে পাকিস্তানে চলে গেলেন। খ্যাতি পেলেন। ঘুরলেন ইউরোপ-আমেরিকা। চাইলে দূরদেশেও নিজের জীবন সঁপে দিতে পারতেন। হতে পারতেন খ্যাতিমান আর বিত্তশালী, কিন্তু সেখান থেকেও পালালেন। ফিরে এলেন জন্মভিটা—নড়াইলে।

দেশে ফিরেও পালালেন তিনি। এবার অন্য কোথাও নয়। নাগরিক সমাজ, খ্যাতির ভিড় আর করপোরেট দুনিয়া থেকে। রাজধানীকেন্দ্রিক যেখানে দেশের শিল্পচর্চা, সুলতান সেখানে বেছে নিলেন তাঁর নিজস্ব পথ। পলেস্তারা খসে পড়া পুরোনো জমিদারবাড়ি আর প্রকৃতিঘেরা জীবনকে বেছে নিলেন তিনি। তাঁর ক্যানভাসেও উঠে এল প্রকৃতির সন্তানেরা। বাংলার কৃষক হয়ে উঠল তাঁর ছবির চরিত্র।

শিল্পী হিসেবে খ্যাতির মোড়ক থেকে নিজেকে বের করে একেবারে বোহিমিয়ান ঘোড়ায় চড়ে জীবন আস্বাদন করলেন শিল্পী এস এম সুলতান। সেই আস্বাদন থেকে উদিত চিন্তা তিনি ঢেলে দিয়েছেন শিল্পে। তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর নাগরিক পন্থা কতটুকু কাজের! তা হয়তো জানা নেই। কিন্তু বোহিমিয়ান এই শিল্পীর শিল্প যে নাগরিক জীবনে বেঁচে থাকবে শত শতবর্ষী হয়ে—এ ভারি বলা যায়।

আয়োজন

শিল্পী এস এম সুলতানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এস এম সুলতান ফাউন্ডেশন, নড়াইল জেলা প্রশাসন, জেলা শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে এস এম সুলতানের রুহের মাগফিরাত কামনা করে সুলতান কমপ্লেক্সে সকাল ছয়টায় কোরআনখানি, নয়টায় শিল্পীর সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি, সোয়া নয়টায় তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মাহফিল। জেলা প্রশাসক ও সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি শারমিন আক্তার জাহান জানান, সুলতানের ১০১তম জন্মবার্ষিকী যথাযথভাবে উদ্‌যাপনের লক্ষ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট শিল্পী সুলতান নড়াইল শহরের মাছিমদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক পান। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্ট আর্টিস্ট এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সম্মাননারও স্বীকৃতি পান তিনি। সুলতানের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তাঁর নিজ বাড়িতে নির্মিত হয়েছে এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। নড়াইলের নিজ বাড়িতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button