শিরোনাম

ঢাবির সিদ্ধান্তে বাড়ল উত্তাপ

ঢাবির সিদ্ধান্তে বাড়ল উত্তাপ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন আগামী ৯ সেপ্টেম্বর। এই নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখায় ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে বিরোধ আরও বেড়েছে। বেশির ভাগ ছাত্রসংগঠন এই নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করলেও কোনো কোনো ছাত্রসংগঠন এই সিদ্ধান্তকে সমর্থনও করেছে। ছাত্রসংগঠনগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থানে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলে আসন্ন ডাকসু নির্বাচনে হল সংসদে কী ছাত্রসংগঠনগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে, নাকি হলে নির্দলীয় প্রার্থী থাকবেন–এমন প্রশ্নও এসেছে সামনে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, হল পর্যায়ের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে তাদের আলাপ-আলোচনা চলছে। এ নিয়ে শিগগির সিদ্ধান্ত হবে।

অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া গতকাল শনিবার রাজশাহীতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, তিনি মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ছাত্রসংগঠনগুলো যদি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করত, তাহলে তাদের মধ্যে মুখোমুখি বিদ্বেষমূলক পরিস্থিতি এবং হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের মতো সিদ্ধান্ত আসত না।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিষিদ্ধঘোষিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগবিহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন। ক্যাম্পাসগুলোতে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরিতে মাঠে নামে বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন এবং বামপন্থী বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমর্থিত বলে পরিচিত।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ হয়েছে। একে অন্যকে দোষারোপ করেছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ। তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু, ১১ সেপ্টেম্বর রাকসু ও ১৫ সেপ্টেম্বর জাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে হল সংসদের নির্বাচনও হয়।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ছাত্রসংগঠনগুলো আরও জোরেশোরে তৎপর হয়। নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে সংগঠনগুলো সভা-সমাবেশ, বিভিন্ন কর্মসূচিতে শক্তি প্রদর্শন করছে। এই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো সংগঠন প্রতিপক্ষকে বিষোদগারও করছে। এ অবস্থায় গত শুক্রবার রাতের ঘটনা পরিস্থিতিতে নতুন উত্তাপ যুক্ত করল। এ জন্য ছাত্রদল ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ প্রতিদ্বন্দ্বী একটি সংগঠনের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা বহাল হয়েছে শুক্রবার ঢাবির ১৮টি হলে ছাত্রদল আহ্বায়ক কমিটি দেওয়ার পর হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে রাতেই ‘সাধারণ শিক্ষার্থীর’ ব্যানারে বিক্ষোভের পর।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৮টি হলে ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার গভীর রাতে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীর’ ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করে হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান। একপর্যায়ে রোকেয়া হল ও শামসুন নাহার হলের ছাত্রীদের একাংশ হলের ফটকের তালা ভেঙে বের হয়ে এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। রাত ১টার দিকে তাঁরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন।

দেড় ঘণ্টা আলোচনার পর ঢাবির উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান ও প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রকাশ্য ও গুপ্ত ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দেন। এ সময় প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে। এ ঘোষণার পর সেখানে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

ঢাবি শাখা ছাত্রদল গতকাল বিকেলে ক্যাম্পাসে স্লোগান ছাড়া মিছিল করেছে। মিছিলটি ভিসি চত্বর থেকে শুরু হয়ে টিএসসিতে গিয়ে শেষ হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রগুলো বলছে, শুক্রবার রাতের বিক্ষোভে ইন্ধন দিয়েছে ছাত্রদলের প্রতিদ্বন্দ্বী একাধিক ছাত্রসংগঠন। এর মূল কারণ ক্যাম্পাসে ৫ আগস্ট-পরবর্তী আধিপত্য ধরে রাখা, গোপনে সংগঠনের বিস্তার, ডাকসু নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ এবং দেশের সামগ্রিক রাজনীতির কৌশল।

হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ রাখাকে ছাত্রদল দেখছে ষড়যন্ত্র হিসেবে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে একটি বিশেষ গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে ছাত্রদলের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের নেতা আব্দুল কাদের গতকাল এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, শৃঙ্খলা কমিটি কিংবা ব্যাচ প্রতিনিধির নামে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা হলগুলোতে ছায়া প্রশাসন জারি রেখেছেন। হলের শৃঙ্খলা কমিটির অধিকাংশই ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে যুক্ত।

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে ছাত্রশিবির হলভিত্তিক কোনো রাজনীতি করে না। তাঁদের সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড টিএসসি, মধুর ক্যানটিনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য এলাকায় পরিচালনা করা হয়। সেবামূলক যেসব কার্যক্রম রয়েছে সেগুলো পরিচালনা করতে হলে কার্যক্রম চালান। দলীয় বা রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি তাঁরা হল এলাকায় করেননি।

ঢাবি শাখা ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) সভাপতি মেঘমল্লার বসুও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি যদি থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি জেলা ইউনিট হয়, তবে এর অধীনে অন্যান্য শাখা ইউনিট থাকা স্বাভাবিক। রাজনীতি করাটাও একটা অধিকারের বিষয়। কারও যেমন রাজনীতি না করার অধিকার আছে, তেমনি রাজনীতি করারও অধিকার আছে।

তফসিল অনুযায়ী আগামী মাসে ডাকসু নির্বাচন থাকায় হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হল সংসদের নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী হবে, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের মতো হল সংসদেও কী সংগঠনগুলো প্যানেল দিতে পারবে, নাকি প্রার্থীরা নির্দলীয়ভাবে প্রার্থী হবেন? কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টি পরিষ্কার না করায় এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ডাকসু নির্বাচন পেছানোর এবং এই নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হওয়ার সংশয়ও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

জানতে চাইলে ঢাবির প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন পেছানোর সম্ভাবনা নেই, অবশ্যই নির্বাচন হবে। হল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি কেমন হবে তা নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করছি। আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হইনি। আশা করি আমরা শিগগির একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হব।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশ্লেষকেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দরকার কেন? বুদ্ধিটা আসলে কার? কেন? রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের কথা না ভেবে পুরোটা বন্ধ করার চেষ্টা যাঁরা করছেন, তাঁরা একটু কল্পনা করেন তো ২০২৪ সালে শিক্ষার্থীরা রাজনীতি না করলে কী হতো?’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ’৭৩-এর আদেশে চলে। এ আদেশ অনুযায়ী এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার কার এবং কী প্রক্রিয়ায় সেটা হতে হবে?’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি, লেজুড়বৃত্তিভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, গুপ্ত রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমি মনে করি পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এ বিষয়ে আমাদের ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

এদিকে ঢাবি হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ রাখার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিষয়ে গতকাল রাজশাহীতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। আমাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর আরেকটু ম্যাচিউরড হওয়ার সুযোগ ছিল। এখন শিক্ষার্থীবান্ধব একটা রূপরেখা প্রণয়ন করে বোঝাপড়া হতে পারে এবং তার ভিত্তিতে আগামীতে চলতে পারে।’



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button