বাঙালি মুসলমান ও রবীন্দ্রনাথ: এক দ্বান্দ্বিক সাংস্কৃতিক রাজনীতি


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নামগুলোর একটি হলেও কেন বাঙালি মুসলমানদের একটি বৃহৎ অংশের কাছে অগ্রহণযোগ্য? কেন দেড় শ বছর আগের এক কবির সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের রয়ে গেছে একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক?
এই দ্বন্দ্বের শুরু কোথায়
এই পর্যালোচনার শুরুতেই আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ বা প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে।
সিপাহি বিদ্রোহের সামনের সারিতে থাকা নেতাদের নামগুলো এখানে লক্ষণীয়—বাহাদুর শাহ জাফর, মৌলভি আহমদুল্লাহ শাহ, বখত খান। এই মুসলমান নেতাদের আধিক্য ও ভূমিকার কারণে ব্রিটিশরা এই বিদ্রোহের মূল প্ররোচক হিসেবে দায়ের বোঝাটা সম্পূর্ণভাবে মুসলমানদের ওপরেই চাপিয়ে দেয়। ফলস্বরূপ মুসলমানদের চাকরি, জমি, শিক্ষা—সবকিছুতে কোণঠাসা করে ফেলা হয়।
মুসলমানরা মোগল আমলে প্রশাসনিক পদে থাকা সত্ত্বেও সিপাহি বিদ্রোহ-পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা প্রশাসনিক কাজে মুসলমানদের নিয়োগ প্রায় বন্ধ করে দেয়। এর ফলে দেখা যায়, বাংলায় নবাবি আমলে উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবী মুসলিম শ্রেণি থাকলেও, ১৮৬০-এর পরের দশকে তাদের সরকারি চাকরির হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়।
বিদ্রোহে জড়িত থাকার দায়ে ও সন্দেহে ভারতজুড়ে মুসলমান জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করার ঘটনা ঘটে বলে আমরা জানতে পারি ইতিহাস থেকে। নবাব ওয়ালিদ খানের নেতৃত্বে বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী খানপুর এস্টেটের মুসলিম জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত হয়। তার মধ্যে এক আবদুল লতিফ খানই ছিলেন খানপুর এস্টেটের ২২৫টি গ্রামের মালিক, যাঁকে নির্বাসন দেওয়া হয় আন্দামানে। জমিদারি বাজেয়াপ্ত করে ফাঁসি দেওয়া হয় বারকাগড় এস্টেটের রাজাকে। এভাবে বুলন্দ শহর, উত্তর প্রদেশ, বারকাগড় এস্টেট, রাঁচি, ঝাড়খন্ড, দিল্লি কিংবা আওধ অঞ্চলে মুসলমান জমিদারেরা জমিদারি হারিয়ে ফেলেন। তাঁদের জায়গায় ব্রিটিশ অনুগত হিন্দু জমিদারদের সুযোগ দেওয়া হয়।
তৎকালীন মুসলমানেরা উর্দু, ফারসি ভাষায় শিক্ষিত ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা ইংরেজিকে প্রধান ভাষা করার পর তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তৎকালীন মুসলমান পরিবারগুলোর মধ্যে ইংরেজিকে ‘কাফেরি শিক্ষা’ ভাবার প্রবণতা ধীরে ধীরে তাদের শিক্ষাঙ্গন থেকে পিছিয়ে দেয়। ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানে হিন্দুরা জায়গা করে নিলেও মুসলমানেরা ক্রমান্বয়ে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে।
এখানেই সুপ্ত রয়েছে আজকের রবীন্দ্র-দ্বন্দ্বের বীজ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ায় ভারতীয় রাজনৈতিক বলয়ে মুসলমানরা একটা সংখ্যালঘু আইডেনটিটির মধ্যে পড়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ ও জাতিভিত্তিক আইডেনটিটি পলিটিকস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি হিসেবে বরেণ্য হলেও সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়; পাশাপাশি তিনি ছিলেন তৎকালীন হিন্দু জমিদার শ্রেণির প্রতিনিধি, যদিও তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী। তাঁর এই পরিচয়ের কারণেই সে সময়ের মুসলমান সমাজ, যারা তখন ব্রিটিশ ভারতীয় রাজনৈতিক বলয়ে সংখ্যালঘু আইডেনটিটির ভুক্তভোগী হয়ে পড়ে, তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে ‘হিন্দু অভিজাত’ শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। এটিই ক্রমান্বয়ে জনমতে রূপ নেয়।
পরবর্তী সময়ে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর এই বিষয়টি চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। দেশভাগের মূল ভিত্তিই ছিল বিজাতিতত্ত্ব—হিন্দু ও মুসলমান আলাদা জাতি। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে। ফলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নীতি ও সংস্কৃতিতে ইসলামীকরণই ছিল অগ্রাধিকার। এটি মূলত উর্দু-ভাষাভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য না হলেও, বাংলা-ভাষাভাষী পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি জটিল বিষয় হিসেবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ জনমানসে একদিকে ‘হিন্দু জমিদার’ হলেও আরেকদিকে ছিলেন কসমোপলিটন মানবতাবাদী। তাঁর লেখায় ঈশ্বর-ভাবনা, প্রেম, প্রকৃতি, মানবতাবোধ ইসলামি চেতনার পরিপূরক না হওয়ায় তাঁকে কোণঠাসা করার বন্দোবস্তই ছিল তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতা। জাতিভিত্তিক আইডেনটিটি পলিটিকসের এই সাংস্কৃতিক আধিপত্যের লড়াইয়ে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও গানকে ‘হিন্দু সাংস্কৃতিক আধিপত্যের’ প্রতিফলন হিসেবে দেখতেন পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থী অনেক রাজনীতিক ও সংস্কৃতিকর্মী।
ফলস্বরূপ, ষাটের দশকে রবীন্দ্রসংগীত ও সাহিত্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় সেন্সরশিপ। এগুলোকে পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব ওঠে। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ করা হয় রবীন্দ্রসংগীত।
এই সবকিছুর গোড়ায় ছিল পাকিস্তানের ‘ইসলামি জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠার নীতি।
পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের উত্থান এই দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা যোগ করে। এই ভূখণ্ডে পাকিস্তান আধিপত্য বিরোধিতার স্তম্ভ ছিল মূলত দুটি—সেক্যুলারিজম ও জাতীয়তাবাদ। এর ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়ায় পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন সেক্যুলার ক্যাননের মুখপাত্র। ফলে রাষ্ট্র গঠিত হয়ে গেলেও ইসলামপন্থীরা তাঁকে প্রতিপক্ষই ভাবতে থাকে।
সাংস্কৃতিক বিভাজন ও রবীন্দ্রনাথ পুনঃপাঠ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যদিও একটি সম্মিলিত ঐতিহ্য বহন করে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা পশ্চাৎপদ হয়ে পড়লে সাহিত্য পরিমণ্ডলে হিন্দুসমাজের প্রতিনিধিত্বই বৃহৎ আকারে প্রকাশ পায়। সে সময়কার বরেণ্য সাহিত্যিকদের লেখায়, চরিত্রায়ণে, সামাজিক প্রেক্ষাপট বর্ণনায় হিন্দু চরিত্র, সংস্কৃতির প্রাধান্য প্রকট হয়ে দাঁড়ায়, যেখানে সংখ্যানুপাতিকভাবে দুই বাংলা মিলিয়ে মুসলমানেরাই ছিল সংখ্যায় বৃহত্তর। উপর্যুপরি, বাংলা সাহিত্যের সাংস্কৃতিক বিভাজনে দুটি পরস্পরবিরোধী মডেল গড়ে ওঠে। এর একটি বঙ্গ হিন্দু সেক্যুলারিজম, অন্যটি ইসলামি চেতনা ও বাঙালি মুসলমানের আইডেনটিটি পলিটিকস।
বাঙালি মুসলমান ঐতিহাসিকভাবেই একটি দ্বৈত পরিচয়ে বেড়ে উঠেছে; একদিকে সে বাঙালি, অন্যদিকে মুসলমান। ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া; সেখান থেকে ১৯৪৭-এ মুসলিম পরিচয়ে রাষ্ট্রগঠন; ১৯৭১-এ আবার বাঙালি পরিচয়ে সামনে আসা। এগুলোর সঙ্গে অন্তর্নিহিত আইডেনটিটি পলিটিকসের নানা দ্বন্দ্ব থেকেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই টানাপোড়েনের জন্ম নেয়। কারণ, রবীন্দ্রনাথ একদিকে যেমন বাঙালি পরিচয়ের প্রতিনিধি, আরেকদিকে ইসলামি চেতনার সঙ্গে সাংস্কৃতিকভাবে ‘না-সম্পৃক্ত’।
আজকের বাংলাদেশে এই দ্বৈত আইডেনটিটির সংঘর্ষ তাই রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক দুই স্তরেই রবীন্দ্রনাথকে আবার নিয়ে এসেছে কাঠগড়ায়। সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ সে ক্ষেত্রে এই জমিনের আইডেনটিটি পলিটিকসের হাতিয়ার হিসেবেও উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, রবীন্দ্রনাথ কি সেটা হতে চেয়েছিলেন?
এর উত্তর খুঁজতে গেলে এই লেখার শুরু থেকে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে নিরপেক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথ বিশ্লেষণ জরুরি। সে জন্যে রবীন্দ্রনাথের ‘ন্যাশনালিজম’ বইটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তৎকালীন ভারতের এলিট হিন্দুসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের নিয়ে কী ভাবতেন, সেগুলো কিছুটা ফুটে ওঠে এই বইয়ে।
এখানে রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের দুঃখজনকভাবে অবনমিত অবস্থায় থাকার বিষয়ে বলেছেন, ‘The Mohammedan community is in a deplorable condition of degradation.’। তৎকালীন মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেছেন, ‘The Mussalmans are a separate community and they are in such a backward state, educationally and socially, that their case requires special consideration.’ এখানে মুসলমানদের প্রতি আলাদা যত্নবান হওয়ার আহ্বান রয়েছে। তা ছাড়া, তৎকালীন পিছিয়ে পড়া মানেই যে তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য মুছে যাওয়া নয়, সে বিষয় উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘They have had their imperial period, their memories of self-respect are still alive’; এবং এ কারণেই তিনি মুসলমানদের উত্তরণের পথে জোর দিয়েছেন। লিখেছেন, ‘The Muslims of India stand today isolated, and the sooner we face the fact the better for us all.’ এবং এর দায় কার, এই বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে সেই ফ্যাক্টেই ফেরত গিয়েছেন, যেখান থেকে এই লেখার শুরু, ‘The responsibility for the Muslim backwardness lies not entirely on them; much of it has been due to British policies after 1857.’
রবীন্দ্রনাথ বনাম মুসলিম চেতনার দ্বন্দ্ব স্রেফ ব্যক্তিগত রুচির প্রশ্ন নয়। এটা ইতিহাস, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক হেজেমনির প্রশ্ন। তাই ভবিষ্যতের জন্য একটি পরিপক্ব বাংলাদেশ গড়তে রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে পাঠ করা জরুরি। একজন ‘হিন্দু কবি’ হিসেবে নয়, বরং একজন মানবিক ও সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধি হিসেবে।
কারণ, দিন শেষে এই দেশের বহুত্ববাদ বানচাল করে আমরা এগোতে পারব না। আমাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো মতামতকে জয়ী করার চেয়ে আমাদের বৈচিত্র্য ধারণ করার প্রয়োজনীয়তা বেশি। আর এই ‘হরমনি’ অর্জন করতে হলে রবীন্দ্রনাথকে এই আইডেনটিটি পলিটিকসের হাতিয়ার বানিয়ে আমাদের কোনো মোকাম হাসিল হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। তার চেয়ে এই বৈচিত্র্যকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে নিজ ধারার সাহিত্য বিকাশে মনোযোগ দিলেই হয়তো গড়ে উঠবে একটি নতুন বাঙালি মুসলমান চেতনা, যেখানে ইসলামি আত্মপরিচয় ও বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সংঘর্ষের বদলে সৃষ্টি হবে একটা অতি প্রয়োজনীয় সহাবস্থান।