গুলিগুলো এমনভাবে আঘাত করছিল যেন খই ফুটছে: চোখ হারানো পারভীন


শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে চোখ হারানো পারভীন। নির্বাচনের আগে এই সরকারের আমলেই বিচার শেষ করার দাবি জানান তিনি।
গতকাল সোমবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেন পারভীন। এ সময় তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার নির্দেশে পুলিশ গুলি করেছে। হাসিনা ছিলেন পুলিশের মা-বাবা। আমার মতো হাজারো মানুষ আহত হয়েছে, নিহত হয়েছে। নির্বাচনের আগে বিচার হোক। শাস্তি না হলে সন্ত্রাসী, খুন-খারাবি বেড়ে যাবে।’
বরিশালের পারভীন ঢাকার যাত্রাবাড়িতে স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এই নারী। এখন তাঁর বাম চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। আর ডান চোখে খুব সামান্য ও ঝাপসা দেখছেন।
জবানবন্দিতে পারভীন বলেন, গত বছরের ১৮ জুলাই কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় যাত্রাবাড়ি এলাকায় অনেকে আহত হয়ে রাস্তার ওপর পড়ে আছে দেখতে পান। কারও হাত নেই, কারও পা নেই। ওই সময় ফ্লাইওভারের নিচে দেখেন ১৮-১৯ বছরের একটা ছেলে চিৎকার করে বাঁচানোর জন্য আকুতি করছে। ওই ছেলেকে দেখে মায়া হলে তিনি টেনে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য রিকশা খোঁজ করছিলেন। ওই সময় ১৪-১৫ পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে।
স্মৃতিচারণ করে পারভীন বলেন, ‘গুলিগুলো ছেলেটার পিঠে এমনভাবে আঘাত করছিল যেন খই ফুটছে।’
তিনি আরও বলতে থাকেন, ‘আমি বাম হাত তুলে গুলি না করতে অনুরোধ করি। তখন পুলিশ আমার বাম চোখে গুলি করে। দুই-তিনজন পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে আমার তলপেটসহ কয়েক জায়গায় গুলি লাগে। এ সময় ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। রক্ত পড়ে শরীর দুর্বল হয়ে একসময় মাটিতে পড়ে যাই। ওই সময় গুলি খেয়ে পড়ে থাকা ছেলেটি আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে নিশ্বাস নেয়। পরে সে আমাকে ছেড়ে দেয়। মনে হলো ছেলেটি মারা গেছে।’
পারভীন বলেন, ‘চোখে গুলির কারণে ব্যথা ও যন্ত্রণায় আমি ছটফট করতে থাকি এবং বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকি।’
এসব কথা বলতে গিয়ে বারবার ট্রাইব্যুনালে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
পারভীন জবানবন্দিতে আরও বলেন, ‘আমাকে লোকজন উদ্ধার করে সিএনজিতে করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে। তবে সেখানকার সাধারণ মানুষের চাপে চিকিৎসা দিতে রাজি হয়। একজন নার্স ২৫০ টাকা চায় ড্রপ কেনার জন্য। আমার কাছে না থাকায় একজন মহিলা টাকা দেন। পরে ড্রপ এনে আমার চোখে দেওয়া হয়। এরপর আর কোনো চিকিৎসা না দিয়ে আমাকে বারান্দায় ফেলে চলে যায়। আমি এক মহিলার মোবাইলের মাধ্যমে বরিশালে থাকা স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি পরদিন সকালে হাসপাতালে আসেন। স্বামীর অনেক অনুরোধের পর ডাক্তার অপারেশনের জন্য ওষুধের স্লিপ লিখে দেয়। স্বামী বাসায় গিয়ে আমার কানের দুল বিক্রি করে ওষুধ নিয়ে গেলে অপারেশন করে কয়েকটি গুলি চোখ থেকে বের করে। তবে আরও গুলি চোখের গভীরে থাকায় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে যেতে বলা হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসা না দেওয়ার অভিযোগ তুলে পারভীন বলেন, ‘চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে যাবার পর পরীক্ষা–নিরিক্ষায় দেখা যায় চোখে ও শরীরে গুলি আছে। তারা ভর্তি করে। কিন্তু কোনো অপারেশন করেনি। অপারেশন হয়েছে ৫ তারিখে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর।’
পারভীন বলতে থাকেন, ‘চিকিৎসার অভাবে বাম চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। আর ডান চোখে খুব সামান্য ও ঝাপসা দেখি। আমি ৮ মাসের অন্তসত্ত্বা। আমার দুটি ছোটো সন্তান আছে। এই অবস্থায়ও এসেছি ন্যায় বিচারের জন্য।’
জবানবন্দী শেষ হলে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন পারভীনকে জেরা করেন। পরে ৬ আগস্ট পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়।
এর আগে ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করা হয়। শেখ হাসিনা ছাড়া এই মামলার বাকি দুই আসামি হলেন—সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। যদিও এই মামলায় সাবেক আইজিপি এরইমধ্যে রাজসাক্ষী হয়েছেন। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক।
গত ১ জুন তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ওই দিন অভিযোগ আমলে নিয়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তবে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব না হলে হাজির হতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে নির্দেশ দেন ১৬ জুন।
বিজ্ঞপ্তি জারির পরও হাজির না হলে ২৪ জুন দুইজনের জন্য ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৮-এর সাবেক বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর ও আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবী আমির হোসেনকে নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল।