রেজা পাহলভি কি খামেনির বিকল্প হতে পারবেন?


ইসরায়েলের আক্রমণে শীর্ষ ইরানি সামরিক কর্মকর্তাদের মৃত্যু, তেহরানে ক্রমাগত বিস্ফোরণ ও যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, ইরানে ইসলামি শাসনব্যবস্থার পতন কি এবার হতেই চলেছে? অনেক বিশ্লেষক বলছেন, খামেনির পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘আমরা জানি, খামেনি কোথায় লুকিয়ে আছেন, তাঁকে হত্যা করা সম্ভব। তবে আপাতত আমরা তা করছি না।’ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, খামেনিকে হত্যা করলেই যুদ্ধ বন্ধ হবে।’ যদি সত্যিই পতন ঘটে ইসলামিক রিপাবলিকের। তখন কে আসবে ইরানের ক্ষমতায়?
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইরানিদের মধ্যে যেই নাম সবচেয়ে বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে তিনি ইরানের শেষ সম্রাট মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির পুত্র যুবরাজ রেজা পাহলভি। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত। এক সময় যিনি ইরানের ভবিষ্যৎ রাজা হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তিনি এখন হয়ে উঠেছেন এক প্রতীকী বিরোধী কণ্ঠস্বর। তিনি এখন সরাসরি রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পক্ষে নন, বরং গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে একটি নতুন ইরান প্রতিষ্ঠার কথা বলেন।
ইরানের ভেতরে কোনো গণআন্দোলন গর্জে উঠলেই রেজা পাহলভির নাম ঘুরে বেড়ায় সামাজিক মাধ্যম থেকে আন্দোলনের প্ল্যাকার্ড কিংবা তেহরানের দেয়ালিকায়। তাঁর আহ্বানে বিদেশে থাকা ইরানি প্রবাসী মহলের অনেকেই সংগঠিত হন। তবে ভেতরের বাস্তবতা ভিন্ন। ইরানে তার বাস্তব রাজনৈতিক প্রভাব এখনও ক্ষীণ। বহু ইরানিই শাহ আমলের স্বৈরশাসনের স্মৃতি ভুলে যাননি, বিশেষ করে ধর্মীয় ও সংস্কারপন্থীরা তাঁর ঘোরবিরোধী।
সরকার বা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে ইতিহাসের ধাঁচ ও ধারাবাহিকতার একটি যোগসূত্র থাকে। ইরানের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ১৯৮১ সাল থেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে ইসলাম ও মার্ক্সবাদের সংমিশ্রণে গঠিত সংগঠন মুজাহিদীন-ই-খালক (এমইকে)। মাসউদ রাজাভির নেতৃত্বে তাঁদের আন্দোলন বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠে ইরানে। তবে খোমেনি সরকারের বলপ্রয়োগ ও নৃশংসতার শিকার হয়ে তাঁরা ইরাকে আশ্রয় নেন। তবে ইরাকে গিয়ে এমইকে সাদ্দাম সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে নিজেদের জনপ্রিয়তা হারায়। ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে ইরানে হামলায় অংশ নেয় এমইকে। তখন ইরানের জনগণের চোখে বিশ্বাসঘাতকে পরিণত হয় একসময়ের জনপ্রিয় সংগঠনটি।
আজকের প্রেক্ষাপটেও অনেকটা একই চিত্র। ইসরায়েলের নেতাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেজা পাহলভি ইরানিদের সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নামার আহ্বান জানাচ্ছেন। কিন্তু এসব ডাকে সাড়া মিলছে না। ইরানিরা দেখছেন, খামেনির অপশাসন, দ্রব্যমূল্যর উর্ধ্বগতি, নারীর স্বাধীনতা হরণের চেয়ে ইসরায়েলি হামলা বেশি ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক। বিদেশি হামলার মুখে সরকারবিরোধী আন্দোলনের জায়গা নিচ্ছে ইরানি জাতীয়তাবাদ।
ইরানিরা মনে করছেন, বাইরে থেকে চাপ আসা মাত্রই সরকারবিরোধিতাকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখানো হবে, যেমনটা হয়েছিল এমইকের বেলায়। তাই এখন, সরকার যতই দুর্বল হোক না কেন, বিদ্রোহ নয়—শত্রুকে মোকাবিলাই প্রাধান্য পাচ্ছে জনমনে। তাই রেজা পাহলভির জন্য এই পথ এতটা মসৃণ নয়।
অন্যদিকে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ভেঙে না পড়লে বা বিদ্যমান কাঠামো টিকে থাকলে উত্তরসূরি নির্বাচনের ভার যাবে ‘অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্টস’ নামক ৮৮ সদস্যবিশিষ্ট আলেম পরিষদের হাতে। এখানেই উঠে আসতে পারে কয়েকটি নাম। বিশেষ করে খামেনির পুত্র মুজতবা খামেনি, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ইসলামি রেভলিউশনারি গার্ডের সঙ্গে যুক্ত। তাকে ঘিরে একদিকে রয়েছে পারিবারিক উত্তরাধিকারের সমর্থন, অন্যদিকে রয়েছে গুরুতর সমালোচনা। কারণ ইরানের সংবিধানে পারিবারিক রাজনীতি সমর্থিত নয়।
আরেকটি সম্ভাব্য নাম আলিরেজা আরাফি। তিনি একজন প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা ও গার্ডিয়ান কাউন্সিলের সদস্য। তিনি ধর্মতন্ত্রের প্রতি অনুগত এবং শাসকগোষ্ঠীর প্রিয়জন। যদি ইসলামি প্রজাতন্ত্র টিকে থাকে, তাহলে তিনিই হয়তো পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হতে পারেন।
কিন্তু যদি ইরানে সত্যিই ইসলামিক শাসনব্যবস্থার পতন ঘটে ও একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, তখন রেজা পাহলভি হতেও পারেন সেই পরিবর্তনের মুখ। কারণ তিনি ইরানের রাজ পরিবারের সদস্য হলেও আধুনিক গণতন্ত্রের মুখপাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন।
তবে এই পথ বন্ধুর। ইরান এমন এক দেশ, যেখানে হাজারো মত, বিভাজন ও ইতিহাসের ভার রয়েছে। আজকের ইরানে নেতৃত্ব পরিবর্তনের অর্থ কেবল ব্যক্তি খামেনির বিদায় নয়। একটি আদর্শ, একটি ধর্মতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিদায়। শেষ পর্যন্ত, রেজা পাহলভি হবেন কি নতুন ইরানের নেতা, নাকি ইতিহাসের আরও একটি পাতায় নাম হয়ে থাকবেন—এ সিদ্ধান্ত দেবে ইরানের জনগণ, তার সেনাবাহিনী এবং বিশ্বশক্তিগুলোর ভূমিকাই।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, গার্ডিয়ান, হারেৎজ, নিউজ১৮
লেখক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক