বদলে যাওয়া বাংলাদেশ বদলে দিচ্ছে চীন-মার্কিন-ভারত কৌশলগত অবস্থানও


বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও তাঁর দেশত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যকার ভারসাম্যেও নতুন করে আলোড়ন তুলেছে। বিশেষ করে পাকিস্তান, চীন, ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র—এই চারটি দেশের স্বার্থ এবং কৌশল এখন বাংলাদেশকে ঘিরে নতুন গতিপথ খুঁজছে।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। সীমান্ত চুক্তি, নিরাপত্তা সহযোগিতা, আন্তযোগাযোগ প্রকল্প, এমনকি আন্তঃনদী পানিবণ্টন চুক্তি নিয়েও উভয় দেশ কাজ করেছে। শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে তাঁর সরকারের সম্পর্কের মাত্রা তুলে ধরতে ২০১৮ সালের ৩০ মে বলেছিলেন, ‘আমরা ভারতকে যা দিয়েছি তারা সারা জীবন মনে রাখবে!’
দিল্লি হাসিনাকে একটি ‘স্থিতিশীল সম্পর্কের’ প্রতীক হিসেবে দেখত। ভারতের পূর্বে তাকানোর নীতির অন্যতম বিন্দু ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন ও পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা ভারতের কাছে বড় ধাক্কা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
ভারতের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মহেন্দ্র বেদ ভারত-বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলেন, ‘গত এক বছরে বাংলাদেশে রাজনীতির দৃশ্যপট পুরোপুরি পাল্টে গেছে। হাসিনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে না দেখলেও, বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক পালাবদল ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোর সম্পর্কের সমীকরণ আমূল বদলে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এর আগে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে রক্তক্ষয়ী বিচ্ছেদের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্র পাল্টে দিয়েছিল। গত বছরের পালাবদলে মানচিত্র না বদলালেও, বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের অনেকটাই ঘনিষ্ঠ এবং আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে চীনের সঙ্গে। আর চীন এখন ভারতের চারপাশে প্রভাব বিস্তারের কৌশলে রত।’
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পর্ক স্পষ্ট। দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। বিশেষ করে র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং ভিসা নীতি প্রয়োগ করে তারা হাসিনা সরকারকে চাপ দেয়। ওয়াশিংটনের জন্য বাংলাদেশের বিষয়টি কেবল মানবাধিকার নয়, বরং বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের একটি অংশ। চীনের প্রভাব প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্র এখন দক্ষিণ এশিয়ায় মিত্র বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে—যার মধ্যে নতুন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আগ্রহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়, যখন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলে বাংলাদেশ সফর করে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু, সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের আন্তর্জাতিক অর্থবিষয়ক সহকারী সচিব ব্রেন্ট নেইম্যান ঢাকায় আসেন।
সে সময় মার্কিন সহকারী ট্রেজারি সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে, বাংলাদেশকে সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাসের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আশাবাদী যে, প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দুর্বলতা মোকাবিলা করতে পারবে এবং অব্যাহত প্রবৃদ্ধি ও বর্ধিত সমৃদ্ধির ভিত্তি তৈরি করতে পারবে।’
পরে, ট্রাম্প বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করলে ফের ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে সরাসরি আলোচনার পথ খুলে যায়। গত জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে শুরু করে চলতি আগস্টের প্রথমদিকে বাংলাদেশের বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ওয়াশিংটনে সরাসরি মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। আলোচনায় কেবল বাণিজ্য নয়, ভূরাজনৈতিক বিষয়ও গুরুত্ব পেয়েছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা, দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নীতির দিকনির্দেশনার মতো বিষয়ও ছিল আলোচনার পরিধিতে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই দিকগুলো ঘিরেই কাঠামোগত আলোচনা শুরু হয়েছে। সে সময় সূত্র জানিয়েছিল, ওয়াশিংটন চায়, বাংলাদেশ একটি নির্দিষ্ট কৌশলগত নীতিগত পথ অনুসরণ করুক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ড. ইউনূসের অধীনে বাংলাদেশের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ক ভালো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশ বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক থমাস কিন বলেন, ‘সরকারের প্রতি সমর্থন এবং ড. ইউনূসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক থাকায় অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার চেয়ে ওয়াশিংটনের প্রতি বেশি ইতিবাচক।’
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। ২০২৪ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। তা সত্ত্বেও, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে ভবিষ্যতে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।
কিন বলেন, ‘তারা (বাংলাদেশ) কেবল ২০ শতাংশ শুল্ক নিশ্চিত করেছে, যা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মতোই এবং ভারতের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত ২৫ শতাংশ শুল্কের চেয়ে কম।’ এই ফল ঢাকাকে ‘অনেকটা স্বস্তি’ দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তবে ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির হিউম্যানিটারিয়ান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের অ্যাডজাঙ্কট রিসার্চ ফেলো মুবাশ্বির হাসান, ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে ‘ব্যাপক পরিবর্তনের’ চেয়ে ধারাবাহিকতাই বেশি দেখছেন। তিনিও ওয়াশিংটনে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত সম্পর্কের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, বর্তমান মার্কিন সরকার বাংলাদেশের প্রতি ততটা বৈরী নয়।
চীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে নজর রাখলেও সরাসরি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বরং, দেশটি দ্রুত অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং অব্যাহত বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছে। পদ্মাসেতু থেকে শুরু করে কর্ণফুলী টানেল এবং চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে চীনের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের সঙ্গে বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে।
চীনা পর্যবেক্ষকদের মধ্যে উদ্বেগ থাকতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সামাজিক চেতনা ‘পুনর্গঠন’ করে এমন একটি ‘অনুগত’ অংশীদার তৈরি করতে পারে, যা পশ্চিমা মূল্যবোধের সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। চীনের আশঙ্কা, এটি এই অঞ্চলে তার প্রধান কৌশলগত স্বার্থে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রথমত, এটি বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে বাণিজ্য হ্রাস, পণ্য পরিবহনে বাধা এবং লজিস্টিক খরচ বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে, বিশেষ করে অবকাঠামো নির্মাণ খাতে। বর্তমান পরিবর্তনগুলো যদি কোনো কারণে চীনা স্বার্থের বিপরীতে যায় তাহলে হয়তো, এসব প্রকল্প বিলম্ব, এমনকি বাতিল হতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, বাংলাদেশের সঙ্গে যদি চীন ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখতে না পারে তাহলে দেশটির বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে (বিআরআই) নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশে বিআরআই স্থবির হয়ে আছে। তবে আশঙ্কা রয়েছে—এটি এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও একটি ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, চীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একাধিক চ্যানেলের মাধ্যমে পৌঁছে বাংলাদেশের প্রতি বেইজিংয়ের পূর্বের প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিচ্ছে।
এদিকে, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বাংলাদেশে চীনা-অর্থায়নে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করছেন এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
অন্যদিকে, সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে চীনের আশঙ্কা থাকতে পারে যে, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপকতর উপস্থিতি চীনের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হতে পারে। এমনটা হলে যুক্তরাষ্ট্র শুধু মালাক্কা প্রণালির ওপরই অধিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না, বরং মিয়ানমারের জটিল রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে দক্ষিণ-পশ্চিম চীন থেকে মিয়ানমারের কায়াকফিউ বন্দরের পরিবহন লাইনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি ভারত মহাসাগর নিয়ে চীনা পরিকল্পনায় বড় বাধা সৃষ্টি করবে। কিছু চীনা পর্যবেক্ষক আরও মনে করেন, বাংলাদেশে যেকোনো মার্কিন সামরিক উপস্থিতি চীন-ভারত সীমান্তে বিদ্যমান ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
বাংলাদেশও চীনের সঙ্গে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই বজায় রেখেছে। চলতি বছরের মার্চে ড. ইউনূস তাঁর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে চীন যান। সাধারণত, বাংলাদেশের সরকার প্রধানেরা প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতকেই বেছে নেন। কিন্তু ড. ইউনূস ভারতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ঐতিহ্য থেকে সরে আসেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার চীনা বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদান নিশ্চিত করেছেন। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চীন সফরের আগে ভারতের সফরের জন্য যোগাযোগ করা হলেও দিল্লির পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি।
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে থমাস কিন বলেন, ‘নিঃসন্দেহে, বাংলাদেশ ও চীন তাদের সম্পর্ক জোরদার করছে।’ তিনি বলেন, ‘বেইজিং বুঝতে পেরেছে যে ঢাকায় একটি কৌশলগত সুযোগ তৈরি হয়েছে যা আগে ছিল না।’ তাঁর মতে, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ‘তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন লাভের জন্য সব অংশীদারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী।’
থিংক ট্যাংক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ফেলো জোশুয়া কুরলান্টজিক উল্লেখ করেন, যদিও হাসিনা বেইজিংয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন, তবে ড. ইউনূস সেই সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছেন।
তবে মুবাশ্বির হাসান জোর দিয়ে বলেন, এই সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের খুব বেশি চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, বেইজিং ‘এটা বুঝতে পেরেছে যে বাংলাদেশের উন্নয়ন তহবিল প্রয়োজন…এবং অবকাঠামো উন্নয়নের চাহিদা আছে এবং বেইজিং এমন একটি অংশীদার যারা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করে।’
অন্যদিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবন একটি কৌশলগত বার্তা বহন করে। এক সময়ের তিক্ত সম্পর্কের সেই ইতিহাস থেকে অনেকটাই সরে এসে নতুন সরকার ইসলামাবাদের সঙ্গে নরম সম্পর্ক গড়ছে। বাণিজ্য, ধর্মভিত্তিক কূটনীতি এবং আঞ্চলিক ফোরামে (যেমন ডি-৮) সহযোগিতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে এই সম্পর্ক এগোচ্ছে। অবশ্য এই বিষয়টি ভারতের কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তারা মনে করছে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে একটি নতুন কৌশলগত অক্ষের দিকে যাচ্ছে—যা ভারতীয় কূটনীতির জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত।
বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের তেমন কোনো মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। কারণ, পাকিস্তানের সঙ্গে এই দুই দেশেরই ভালো সম্পর্ক আছে। কিন্তু ভারত এটি নিয়ে খুবই অস্থির হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি, ভারত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার বিষয়েও অবগত। এই বিষয়টি নয়াদিল্লির কর্তাব্যক্তিদের খুবই মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে।
চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও উন্নত হওয়ার বিষয়ে মহেন্দ্র বেদ বলেন, ‘চীন একসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই পাকিস্তানের অলওয়েদার অ্যালাই বা পরীক্ষিত মিত্র হিসেবে পরিচিত। সেই চীনই এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী এবং বাণিজ্যিক অংশীদার। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যেমনই থাকুক, ঢাকা এখন চীন ও পাকিস্তানকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এই জিরো-সাম গেম ভারতকে তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং বৈদেশিক নীতিতে চাপে ফেলছে।’
ভারতীয় বিশ্লেষকদের ধারণা, ভারত অর্থনৈতিকভাবে বড় হলেও, বাংলাদেশকে দেওয়া রপ্তানি সুবিধার পেছনে ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থন নিয়ে নয়াদিল্লিতে সন্দেহ দানা বাঁধছে। কারণ, বাংলাদেশের ওপর শুল্ক ২০ শতাংশ হলেও ভারতের ওপর আরোপ করা হয়েছে ২৫ শতাংশ এবং আরও ‘পেনাল্টি’ আরোপের হুমকি দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প। ক্ষমতার অন্দরমহলে ধারণা আছে যে, বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই বাড়তি নজর জো বাইডেনের আমল থেকেই শুরু হয়।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এখন এক নতুন বলয়ের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’—নীতির বাস্তবায়নে এখন একাধিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলছে, কিন্তু কোনো শিবিরে সরাসরি যুক্ত হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক কূটনীতির পরিভাষায় এটিকে ‘হেজিং’ কৌশল বলা হয়। এ কৌশল অল্প কয়েকটি দেশ দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে পারে, বাংলাদেশ সরকার সে চেষ্টাই করছে।
কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন কোনো পক্ষে হেলে পড়ছে না। যেমন, চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সহায়তা গ্রহণ করলেও সামরিক বা কৌশলগত বলয়ে একীভূত হচ্ছে না। এটি বাংলাদেশ সরকারের একটি সচেতন ভারসাম্য কৌশল। বাংলাদেশ চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো কৌশলগত জোটে যোগ দিচ্ছে এমন কোনো প্রমাণ এখনো দেখা যায়নি, যদিও এ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা রয়েছে।
কুরলান্টজিক বলেন, ‘আমি মনে করি না যে, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে কোনো কৌশলগত জোট গঠন করবে। তাদের তো এমন কোনো নির্বাচিত সরকারও নেই, যারা এ ধরনের বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’ কিনও তাঁর সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, এমন কোনো জোট হলে তা ভারতের জন্য একটি ‘রেড লাইন’ বা বিপৎসীমা হবে।
কিন বাংলাদেশের বর্তমান পদক্ষেপগুলোকে দিল্লির ‘বৈরী মনোভাবের’ জবাবে একটি কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা হিসেবে দেখছেন। কিন আরও বলেন, ‘ড. ইউনূসের প্রধান লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।’
এই অবস্থানই প্রতিধ্বনিত হয় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের কথা থেকে। গত ২৯ ডিসেম্বর তিনি বলেছিলেন, ‘ঢাকাকে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে, কারণ বাংলাদেশের রক্ষা করার মতো স্বার্থ রয়েছে এবং এটি বৈশ্বিক অঙ্গনে একটি বড় খেলোয়াড় নয়।’
তবে বাংলাদেশের এই ভারসাম্য রক্ষার পথ খুব সহজ নয়। একদিকে ভারতের মনোভাব পরিবর্তন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বৈরীভাবে বৃদ্ধির সম্ভাবনা, সেই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কের জটিলতা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান এখন অনেক বেশি জটিল ও সংবেদনশীল।
লেখক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক
তথ্যসূত্র: আজকের পত্রিকা, আনাদোলু এজেন্সি, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন, রয়টার্স ও দ্য ডন