শিরোনাম
খুলনায় শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ, কিশোর গ্রেপ্তারআখ চাষ করে চিনিশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে: অতিরিক্তি সচিব রশিদুল হাসানযুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের শিকল পরিয়ে ফেরত: বাংলাদেশিদের ট্র্যাজেডিসশস্ত্র বাহিনী দায়িত্বে, ফেরারি আসামি প্রার্থী অযোগ্য, জামানত ৫০ হাজার টাকামিলমালিকদের শুল্ক পুনরায় আরোপের দাবি ও বাজার সংকটের আশঙ্কামাতারবাড়ী-মহেশখালীতে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন: সিঙ্গাপুর-মডেল টাউনশিপ পরিকল্পনা‘আগে নাগরিক সুবিধা দাও, পরে হোল্ডিং চার্জ নাও’পতিতাবৃত্তির অভিযোগে উত্তরায় আবাসিক হোটেল থেকে পাঁচ যুবতীসহ গ্রেপ্তার ১২এখনো খোলা আকাশের নিচে হাজারো ক্ষুধার্ত মানুষনাটোরে পেটের অসুখে ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ১৪৭

বিজয়, আনন্দ ও অলৌকিক নিদর্শন

বিজয়, আনন্দ ও অলৌকিক নিদর্শন

মানব ইতিহাসের কিছু মুহূর্ত সমগ্র বিশ্বের জন্য যুগান্তকারী হয়ে দাঁড়ায়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম সেইরূপ এক ঘটনা। প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী, তিনি ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় পবিত্র মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের হাশেমি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের মাধ্যমে বিশ্বজগৎ পেয়েছে মুক্তি, রহমত ও আলো।

আল্লাহ তাআলা নবীজির জন্মকে সাধারণ কোনো জন্ম হিসেবে রাখেননি; বরং এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন একাধিক অলৌকিক ও ঐতিহাসিক ঘটনা, যা এই মহান জন্মকে অনন্য মহিমায় সমুজ্জ্বল করেছে।

১. হস্তিবাহিনীর ধ্বংস হওয়া: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মের ৫০-৫৫ দিন আগে হস্তিবাহিনীর ধ্বংসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা ছিল নবী (সা.)-এর আবির্ভাবের অলৌকিক ইঙ্গিত ও ঘোষণা। হাবশার সম্রাট নাজ্জাসির পক্ষ থেকে ইয়েমেনের গভর্নর ছিল আবরাহা। সে রাজধানী সানায় খুব সুন্দর ও বড় গির্জা নির্মাণ করে চেষ্টা করল, যেন লোকেরা কাবাগৃহ ত্যাগ করে ইবাদত ও হজ-ওমরাহর জন্য সেখানে যায়।

এ কাজ মক্কাবাসী তথা অন্য আরবদের পছন্দ হয়নি। তারা কাবা ছেড়ে অন্য কোনো স্থানে যেতে রাজি হয়নি। এতে আবরাহা রাগান্বিত হয়ে কাবা ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে হাতির দল নিয়ে মক্কার দিকে অগ্রসর হয়। মক্কার কাছে পৌঁছে তারা মক্কার প্রধান [নবী (সা.)-এর দাদা] আবদুল মুত্তালিবের উটগুলো দখল করে নেয়। আবদুল মুত্তালিব আবরাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কেবল তাঁর উটগুলো ফেরত চায় আর কাবার বিষয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা প্রকাশ করে।

অতঃপর যখন এই সেনাদল মিনাসংলগ্ন ‘মুহাসসার’ উপত্যকায় পৌঁছে, তখন আল্লাহ তাআলা একটি পাখির দলকে প্রেরণ করেন, যাদের ঠোঁটে ও পায়ে পোড়া মাটির কাঁকর ছিল। পাখিগুলো ওপর থেকে সেই কাঁকর বর্ষণ করে। ফলে তারা ধ্বংস হয়ে যায়।

আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি দেখোনি, তোমার প্রতিপালক হাতিওয়ালাদের সঙ্গে কী করেছিলেন? তাদের কৌশল কি তিনি বিফল করেননি? তিনি তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেছিলেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। যারা নিক্ষেপ করছিল তাদের ওপর পোড়া মাটির পাথর। অতঃপর তিনি তাদের করলেন ভক্ষিত তৃণসাদৃশ।’ (সুরা ফিল: ১-৫)

২. দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি: নবী (সা.)-এর জন্মের পূর্ববর্তী কয়েক বছর আরব উপদ্বীপ বিশেষ করে হিজাজ অঞ্চলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল। মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাত। কুরাইশ গোত্রসহ আরবের অধিকাংশ গোত্র চরম সংকটে পতিত হয়েছিল।

নবীজির জন্মের বছর আরবের সেই দুর্ভিক্ষ কেটে যায়। আরবের ঘরে ঘরে আনন্দের ফল্গুধারা বইতে থাকে। যেহেতু একই বছরে কুরাইশরা আবরাহার বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল এবং দুর্ভিক্ষ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল, তাই বছরটিকে আরববাসী ‘সানাতুল ফাতহ ওয়াল ইবতিহাজ’ অর্থাৎ ‘বিজয় ও আনন্দের বছর’ নাম দিয়েছিল। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৬৫; আস-সিরাতুল হালাবিয়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৮)

৩. নবীজির আগমনী বার্তা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে পড়া: নবী (সা.)-এর জন্মের খবর শুধু আরবেই নয়, বরং ইহুদি-নাসারা আলেমদের মধ্যেও আলোচিত হয়েছিল। তৎকালীন ইহুদি-নাসারা তাঁদের কিতাবে নবী (সা.)-এর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী পেতেন। নবী (সা.)-এর আগমনের মাধ্যমে আরব, বিশেষ করে কুরাইশ গোত্রের মর্যাদা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, মক্কা শরিফে এক ইহুদি বাস করতেন। যে রাতে নবী (সা.) জন্মগ্রহণ করেন, সে রাতে তিনি বললেন, ‘হে কুরাইশ দল, আজ রাতে কি তোমাদের কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করেছে?’ তারা বলল, ‘আমাদের জানা নেই।’ তখন তিনি বললেন, ‘দেখো, আজ এই উম্মতের নবী আগমন করেছেন। যাঁর দুই কাঁধের মাঝখানে নবুওয়াতের চিহ্ন রয়েছে। তিনি দুই রাত পর্যন্ত দুধ পান করবেন না।’ লোকজন দ্রুত ওই সভা থেকে উঠে অনুসন্ধান শুরু করল। জানা গেল যে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের ঘরে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে।

ওই ইহুদি বললেন, ‘তোমরা আমাকে নিয়ে গিয়ে দেখাও।’ ইহুদি তাঁর দুই বাহুর মাঝখানের মোহরে নবুওয়াতের চিহ্ন দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। জ্ঞান ফেরার পর তিনি বললেন, ‘নবুওয়াত বনি ইসরাইল থেকে চলে গেছে। হে কুরাইশ সম্প্রদায়, শোনো, এই নবীর মাধ্যমে তোমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে তাঁর শুভাগমনের সংবাদ পৃথিবীর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে পড়েছে।’ (মুস্তাদরাকে হাকিম: ৪১৭৭)

৪. নবীজির জন্মক্ষণ ভবিষ্যৎ বিজয়ের ইঙ্গিত: রাসুল (সা.)-এর জন্ম কোনো সাধারণ জন্ম ছিল না, বরং মহান আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর মানুষের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণের নিদর্শনস্বরূপ বিভিন্ন মুজিজা ও আশ্চর্য চিহ্ন দ্বারা তা প্রকাশ করেছিলেন। নবী (সা.)-এর শুভ জন্মের সময় তাঁর মা একটি আলোকচ্ছটা দেখতে পেয়েছিলেন, যার মাধ্যমে সিরিয়ার প্রাসাদগুলো আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। সিরিয়ায় প্রাসাদ আলোকিত হওয়া দ্বারা ভবিষ্যতের ইসলামি সভ্যতার প্রসার এবং রোমান সাম্রাজ্যের পতনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

বাস্তবেও তা-ই হয়েছিল। ইরবাস ইবনে সারিয়্যা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মের সময় তাঁর মা একটি আলোকচ্ছটা দেখতে পান, এর মাধ্যমে সিরিয়ার প্রাসাদগুলো আলোকিত হয়ে যায়। (মুসতাদরাকে হাকিম: ৪১৭৮; মিশকাতুল মাসাবিহ: ৫৭৫৯)

৫. নবীজির জন্মক্ষণে রহমতের নূর: নবীজির জন্মকালে এমন আলো দেখা গিয়েছিল, যা সাধারণ কোনো আলো ছিল না, বরং তা ছিল এক অলৌকিক নিদর্শন। আকাশের তারকারাজি নিকটে চলে আসার যে বিষয়টি পাওয়া যায়, তা ভবিষ্যতের মহান পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে নবী (সা.)-এর আগমনের মাধ্যমে আসমান ও জমিন উভয়ই এক নতুন অধ্যায়ের সাক্ষী হয়েছিল।

ফাতিমা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, যখন নবী (সা.)-এর শুভাগমন ঘটে, তখন আমি আমিনার (নবীজির মা) কাছে উপস্থিত ছিলাম। আমি দেখলাম, প্রতিটি ঘর উজ্জ্বল আলোতে ভরে গেছে। আরও দেখলাম, আসমানের তারকারাজি এত কাছে এসেছে যে আমার মনে হলো—এই তারকা আমার ওপর পতিত হবে।’ (ফাতহুল বারি, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৪২৬)

এই বর্ণনাটি ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ফাতহুল বারিতে উল্লেখ করেছেন। তবে সনদের দিক থেকে এটি শক্তিশালী না হলেও নবীজির জন্মের অলৌকিকতা বর্ণনা করা অন্যান্য সহিহ্ হাদিসের সঙ্গে এর বিষয়বস্তু সামঞ্জস্যপূর্ণ।

পরিশেষে বলা যায়, নবীজির জন্মবর্ষের ঘটনাবলি প্রমাণ করে, তিনি ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য বিশেষ রহমত। তাঁর জন্মের বছর আরববাসী পেয়েছিল বিজয়, মুক্তি ও সমৃদ্ধি। তাই সেই বছরকে যথার্থভাবেই বলা হয় ‘সানাতুল ফাতহ ওয়াল ইবতিহাজ’ বা বিজয় ও আনন্দের বছর। এই মহান জন্ম ছিল ইসলামের সূর্যোদয়ের প্রস্তুতি, যা পরবর্তীকালে বিশ্বসভ্যতার দিকনির্দেশক শক্তি হয়ে ওঠে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


ক্রাইম জোন ২৪

আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button