যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের শিকল পরিয়ে ফেরত: বাংলাদেশিদের ট্র্যাজেডি


উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে অপমানজনকভাবে ফেরত আসতে হচ্ছে বাংলাদেশিদের। প্রত্যাবাসনকালে হাতে পরানো হচ্ছে হাতকড়া, শিকলে বেঁধে রাখা হচ্ছে শরীর। অবৈধভাবে অবস্থানের অভিযোগে দেশটি থেকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন আরও একদল বাংলাদেশি। আজ রাত ৯টার দিকে একটি চার্টার্ড বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজে করে তাঁদের ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। উড়োজাহাজটিকে ৭২ ঘণ্টা ঢাকায় অবস্থানের অনুমতি দেওয়া হলেও কতজন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানো নতুন কিছু নয়। এর আগে গত ২ আগস্ট ভোরে একটি সামরিক পরিবহন উড়োজাহাজ সি-১৭ ঢাকায় অবতরণ করে। সেই ফ্লাইটে এক নারীসহ ৩৯ বাংলাদেশিকে দেশে পাঠানো হয়। ফেরত আসা ব্যক্তিদের অভিযোগ, প্রায় ৬০ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রায় তাঁদের হাতকড়া ও শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছিল।
ঢাকায় পৌঁছে ওই ফ্লাইটে ফেরত আসা ফাহিম নামের এক যাত্রী বলেন, ‘আমাদের হাতকড়া ও শিকলে বাঁধা অবস্থায় উড়োজাহাজে করে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যন্ত্রণা নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে, খেতে দেওয়া হয়েছে শুধু রুটি আর পানি। এমনকি টয়লেটে যাওয়ার সময়ও একজন অফিসার আমাদের নিয়ে যেতেন, আবার শিকলে বেঁধে দিতেন। অবশেষে ঢাকায় অবতরণের সময় শিকল খোলা হয়।’
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও এইচএসআইএর ইমিগ্রেশন বিভাগের সূত্র বলছে, এর আগে চলতি বছরের ৮ জুন একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ৪২ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়। ফিরিয়ে আনা ৪২ বাংলাদেশির মধ্যে ১৬ জনের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ পরিচয়পত্র যাচাই নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে একজন যুক্তরাষ্ট্রে মামলায় হেরেও সেখানে অবস্থান করছিলেন, আরেকজন আলাদা মামলায় সাজা ভোগ করেছিলেন। সবাইকে অনিয়মিত অভিবাসী হিসেবে শনাক্ত করা হয়।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের ৬ মার্চ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ৪৬ দিনে একাধিক চার্টার্ড ফ্লাইটে অন্তত আরও ৩৪ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। ২০২৪ সালের শুরু থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশির সংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়েছে।
এর আগে ২০১৬ সালে ২৭ বাংলাদেশিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে। তাঁরা বিশেষ ফ্লাইটে এসেছিলেন, আর যাত্রাপথে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছিল। এই দৃশ্য তখন দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এভাবে শিকল পরানোয় মানবাধিকার ও মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন, যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে আলোচনাও হয়েছিল।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রত্যাবাসনের সময় হাতকড়া ও শিকল ব্যবহার সীমিত করা উচিত। শুধু বিশেষ নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি থাকলেই শুধু হাতকড়া পরানো যেতে পারে।
অপরাধমুক্ত ও অসহিংস অভিবাসীদের হাতকড়া বা শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থী। ফেরত আসা ব্যক্তিদের পুনর্বাসন সহায়তা নিশ্চিত করা, সচেতনতা কার্যক্রম জোরদার করা এবং পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় রাখা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অভিবাসীদের এভাবে হাতকড়া বা শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান আজকের পত্রিকা‘কে বলেন, উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ অভিবাসী হতে চাইবেন, এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একই সঙ্গে গন্তব্য দেশ চাইলে তাঁদের ফিরিয়েও দিতে পারে। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষের জন্য সারা জীবনের ট্রমা হয়ে থাকে। আমরা আশা করি, আগামীতে প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া আরও মানবিক হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে।
প্রসঙ্গত, মার্কিন আইন অনুযায়ী বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অবস্থানকারী অভিবাসীদের আদালতের রায় বা প্রশাসনিক আদেশে দেশে ফেরত পাঠানো যায়। আশ্রয়ের আবেদন ব্যর্থ হলে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ (আইসিই) তাঁদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করে। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রক্রিয়া দ্রুততর করার কারণে চার্টার্ড ও সামরিক ফ্লাইটের ব্যবহার বেড়েছে। বেশির ভাগ অভিবাসী মেক্সিকো বা লাতিন আমেরিকার দেশ হয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় একাধিক দফায় বাংলাদেশিসহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু নাগরিককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
ক্রাইম জোন ২৪