মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম নারী সি রেঞ্জার বাহিনী গঠন করল সৌদি আরব


মধ্যপ্রাচ্যে সর্বপ্রথম নারীদের নিয়ে সি রেঞ্জার বাহিনী গঠন করেছে সৌদি আরব। আজ বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) বিশ্ব রেঞ্জার দিবস উপলক্ষে এই রেঞ্জার বাহিনীর কথা জানান সৌদি আরবের প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান রয়্যাল রিজার্ভ। সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০-এর অংশ হিসেবে পরিবেশ সংরক্ষণ ও নারী ক্ষমতায়নের প্রতি দেশটির প্রতিশ্রুতি তুলে ধরতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পুরুষ রেঞ্জার ও সৌদি বর্ডার গার্ডের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ লোহিত সাগরের উপকূলরেখায় টহল দেবে নতুন এই নারী রেঞ্জার দল। সমুদ্র অঞ্চলটির সংবেদনশীল সামুদ্রিক ও স্থলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন তাঁরা। বর্তমানে প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান রয়্যাল রিজার্ভের রেঞ্জার বাহিনীতে ২৪৬ জন সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে ৩৪ শতাংশই নারী।
সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০ উদ্যোগে বিভিন্ন খাতে, বিশেষ করে পরিবেশ খাতে লিঙ্গসমতা ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। নারীদের পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অন্তর্ভুক্ত করতে এই পদক্ষেপটি নিয়েছে সরকার। আর এই লক্ষ্য পূরণে উল্লেখযোগ্য এক অর্জন হলো, এখন রিজার্ভের ১১টি টিমের মধ্যে ৫ টির নেতৃত্বে রয়েছেন নারী।

রিজার্ভের প্রধান নির্বাহী অ্যান্ড্রু জালুমিস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে সামুদ্রিক সংরক্ষণে, লিঙ্গ সমতা অর্জন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ২০২১ সালে প্রথম রেঞ্জার নিয়োগের সময় থেকেই আমরা নারীদের অন্তর্ভুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছি। আজ সৌদি আরবে পরিবেশ সংরক্ষণের ভবিষ্যৎ গঠনে নারীরা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।’
তিনি আরও বলেন, এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ শুধু সৌদি আরবেই নয়, গোটা অঞ্চলের জন্য একটি শক্তিশালী উদাহরণ, যেখানে ধীরে ধীরে নারীরা ঐতিহ্যগতভাবে পুরুষপ্রধান খাতে নেতৃত্বের দায়িত্ব নিচ্ছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞ পরিবেশবিদ ও সিনিয়র আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ডমিনিক দ্য তুয়ার তত্ত্বাবধানে এক বছর সামুদ্রিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন নবনিযুক্ত এই নারী সি রেঞ্জাররা। তারা সমুদ্র টহল, জলজ নিরাপত্তা, সাঁতার এবং মাঠপর্যায়ে কাজের কৌশল শিখেছেন, যা তাদের রাজকীয় রিজার্ভের চ্যালেঞ্জিং সামুদ্রিক পরিবেশে কাজ করার জন্য প্রস্তুত করেছে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে প্রথম ধাপের সাতজন পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী রেঞ্জার আনুষ্ঠানিকভাবে সক্রিয় টহলে অংশ নেন। তারা এখন রিজার্ভের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।
পরিবেশবিদ ডমিনিক দ্য তুয়া বলেন, ‘এই প্রশিক্ষণ নারীদের শৃঙ্খলা, দৃঢ়তা ও প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। তাদের এই অর্জন কেবল রিজার্ভ নয়, বরং গোটা অঞ্চলের সামুদ্রিক সংরক্ষণের জন্য এক মাইলফলক।’

সৌদি আরবে ২৪ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান রয়্যাল রিজার্ভ। অন্যতম বৃহৎ সংরক্ষিত এই এলাকাটিতে পাহাড়, উপত্যকা, উপকূলরেখা এমনকি সমুদ্রও রয়েছে। অবৈধ শিকার, মাছ ধরা, গাছ কাটাসহ অনিয়ন্ত্রিত চারণের মতো পরিবেশবিধ্বংসী কার্যকলাপ রোধে রেঞ্জাররা প্রতিনিয়ত এই অঞ্চলজুড়ে টহল দিয়ে থাকেন।
রিজার্ভের সামুদ্রিক এলাকা সৌদি আরবের সামুদ্রিক সীমানার মাত্র ১ দশমিক ৮ শতাংশ, কিন্তু এখানেই রয়েছে দেশের ৬৪ শতাংশ প্রবাল প্রজাতি ও ২২ শতাংশ মাছের প্রজাতি। এর মধ্যে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় হকসবিল ও গ্রিন কচ্ছপ, স্পিনার ডলফিন, ডুগং এবং হোয়েল শার্কের মতো দুষ্প্রাপ্য প্রাণী। দুটি বিশেষভাবে নির্মিত জলযানে করে রেঞ্জাররা নিয়মিত এই এলাকা টহল দেন। পাশাপাশি তাঁরা ধূসর ম্যানগ্রোভ বন রক্ষায়ও কাজ করছেন।
২০২২ সাল থেকে রেঞ্জার বাহিনী ভূমি ও সমুদ্র মিলিয়ে প্রায় ৩৫ হাজারটি টহল অভিযান পরিচালনা করেছে। শুধু বন্যপ্রাণী রক্ষাই নয়, পরিবেশগত পর্যবেক্ষণ, বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর পুনর্বাসন, টেকসই পর্যটন ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশগত নিয়মকানুন বাস্তবায়নসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত তারা।
নারীদের নিয়ে এই সি রেঞ্জার বাহিনী সৌদি আরবের পরিবেশ রক্ষায় চলমান বৃহৎ প্রচেষ্টার একটি অন্যতম সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০১৮ সালে রাজকীয় আদেশে গঠিত রয়্যাল রিজার্ভস কাউন্সিল এই পরিবর্তনের মূল চালিকা শক্তি।
সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে পরিচালিত এই কাউন্সিল ছয়টি রয়্যাল রিজার্ভের তত্ত্বাবধান করে, যেগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে। এই কাউন্সিলের কৌশলগত লক্ষ্য হচ্ছে—সৌদি আরবের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ, ইকোট্যুরিজম (পরিবেশবান্ধব পর্যটন) উৎসাহিত করা এবং সৌদি গ্রিন ইনিশিয়েটিভসহ দেশের টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনাকে এগিয়ে নেওয়া।

সৌদি গ্রিন ইনিশিয়েটিভ অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে সৌদি আরবের ৩০ শতাংশ স্থল ও সামুদ্রিক এলাকা সংরক্ষণের আওতায় আনা হবে। এসব উদ্যোগ একত্রে শুধু পরিবেশ রক্ষার পথকেই প্রশস্ত করছে না, বরং সৌদি আরবকে ভবিষ্যতের একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব জাতিতে পরিণত করার লক্ষ্যকেও শক্ত ভিত্তি দিচ্ছে।