শিরোনাম

মতবিরোধের কেন্দ্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান মনোনয়নে ‘র‍্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং’

মতবিরোধের কেন্দ্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান মনোনয়নে ‘র‍্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং’

জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজনের পক্ষে ঐকমত্য হয়েছে সবগুলো রাজনৈতিক দল। তবে এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। স্পষ্টত বিএনপি ও কয়েকটি দলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিমত পোষণ করছে।

এই বিরোধের মূলে রয়েছে ‘র‍্যাঙ্কড চয়েস’ পদ্ধতি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এই পদ্ধতির প্রস্তাব করেছে এবং এতে একমত হয়েছে জামায়াত ও এনসিপি। তবে বিএনপি এই প্রক্রিয়ার সর্বশেষ ধাপ সংসদের ওপর ন্যস্ত করার পক্ষে।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের ২১ তম দিনের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবে অংশগ্রহণকারী তিন-চতুর্থাংশ দল একমত। মূল বিরোধ এখন প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে।

কমিশনের সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়নে একটি পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠিত হবে—প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) ও দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি। যদি এই কমিটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারে, তবে প্রধান বিচারপতির মনোনীত দুই বিচারপতিকে যুক্ত করে সাত সদস্যের কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই কমিটি ‘র‍্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং’-এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে।

‘র‍্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং’ (আরসিভি) বলতে বোঝায়, একটি নির্বাচন পদ্ধতি যেখানে ভোটাররা একটি পদের জন্য প্রার্থীদের তাঁদের পছন্দের ক্রম অনুসারে (প্রথম পছন্দ, দ্বিতীয় পছন্দ, তৃতীয় পছন্দ, ইত্যাদি) র‍্যাঙ্ক করেন। প্রার্থীদের র‍্যাঙ্ক করার এই পদ্ধতি শুধু একজন প্রার্থীকে নির্বাচন করা বা প্রচলিত সাধারণ ভোটিং (সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তকে বিজয়ী ঘোষণা) থেকে ভিন্ন। যদি কোনো প্রার্থী অর্ধেকের বেশি প্রথম পছন্দের ভোট পান, তাহলে তিনি বিজয়ী হন, যেমনটি যেকোনো নির্বাচনে হয়।

তবে, যদি প্রথম পছন্দের ভোট গণনার পর কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয়ী না থাকে, তাহলে তাৎক্ষণিক রানঅফের মাধ্যমে ফলাফল নির্ধারিত হয়। সবচেয়ে কম ভোট পাওয়া প্রার্থীকে বাদ দেওয়া হয় এবং যে ভোটাররা সেই প্রার্থীকে তাঁদের প্রথম পছন্দ হিসেবে র‍্যাঙ্ক করেছিলেন, তাঁদের ভোট তাঁদের পরবর্তী পছন্দের (দ্বিতীয় পছন্দ) প্রার্থীর জন্য গণনা করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে যতক্ষণ না একজন সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি ভোট পাওয়া কোনো প্রার্থী বিজয়ী হন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান মনোনয়নে গঠিত কমিটি প্রথম ধাপে একমত হতে না পারলে কমিটিতে দুজন বিচারপতিকে যুক্ত করা এবং ‘র‍্যাঙ্কড চয়েস’ প্রক্রিয়ার কথা প্রস্তাবে বলা হয়েছে। কিন্তু এ প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপি আপত্তি জানিয়েছে। দলটির দাবি, গঠিত সার্চ কমিটির অচলাবস্থায় বিষয়টি সংসদে পাঠানো উচিত।

অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপি বিচারপতিদের অন্তর্ভুক্তি ও ভোটিং প্রক্রিয়াকে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার সর্বোত্তম উপায় হিসেবে দেখছে।

এ বিষয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে—প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি। তাঁরা ১২ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্য থেকে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান নির্বাচন করবেন।

তিনি বলেন, প্রস্তাব অনুযায়ী, তাঁরা যদি একমত হতে না পারেন, তাহলে প্রথমে সর্বসম্মতভাবে, পরবর্তীকালে ওয়ান চয়েস ভোট, এরপর প্রয়োজনে র‍্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং পদ্ধতির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে। এই পদ্ধতিতে ভোটার হবেন মোট সাতজন—ওপরে উল্লিখিত পাঁচ সদস্য এবং সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের একজন করে বিচারপতি।

জামায়াত নেতা তাহেরের মতে, এই পর্যায়ে দুজন বিচারপতি যুক্ত করা হয়েছে যেন এককভাবে তৃতীয় দল বা অন্য কেউ ডিসাইডিং ফ্যাক্টর (ফল নির্ধারক) না হয়ে যায়।

বিএনপির আপত্তি মূলত এই যে—যদি ঐকমত্য না হয়, তাহলে বিষয়টি সংসদে পাঠানো হোক। তবে জামায়াতসহ অধিকাংশ দল মনে করে, সংসদে পাঠালে তা আর সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে না।

জামায়াত নেতা তাহের বলেন, ‘সংসদে পাঁচ-ছয়টা দল আছে, অথচ এই বডিতে (ঐকমত্য কমিশন) ৩০ টির বেশি দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।’

জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রশ্নে আলোচনায় ‘র‍্যাঙ্কড চয়েস’ পদ্ধতি নিয়ে কয়েক দিন ধরে আলোচনা চলছিল। এই পদ্ধতি অনুযায়ী আজ বিচার বিভাগ থেকে আরও দুই সদস্য যুক্ত করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব এসেছে, যাঁরা ভোট দেবেন।

তিনি বলেন, আমরা এই প্রস্তাবে একমত হয়েছি। আমাদের সঙ্গে প্রায় সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে, কেবল বিএনপি ও কিছু সহযোগী দল ছাড়া।

এদিকে আলী রীয়াজ জানান, আজ নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। সব দল জাতীয় সংসদে নারী আসন ১০০-তে উন্নীত করার ব্যাপারে একমত। তবে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ভিন্নমত রয়ে গেছে। কেউ সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে, কেউ সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীদের আনতে চায়। কমিশনের পক্ষ থেকে প্রথমে প্রস্তাব ছিল, রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ আসনের এক-তৃতীয়াংশে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। পরে তা এক-চতুর্থাংশ এবং এক-পঞ্চমাংশ পর্যন্ত নমনীয় করা হয়।

আলী রীয়াজ বলেন, ‘মহা হিসাব নিরীক্ষক ও ন্যায়পাল নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধানে কমিটি গঠনের বিধান সংযুক্তির প্রস্তাবে এখনো পূর্ণ ঐকমত্য হয়নি। তবে অধিকাংশ দল কমিশনের প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়েছে। ন্যায়পালের নিয়োগ কার্যকর করার বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও, বিএনপি ও তার কয়েকটি মিত্র দল সংবিধানে নতুন বিধান না এনে বিদ্যমান আইনকে শক্তিশালী করার প্রস্তাব দিয়েছে।’

অধ্যাপক রীয়াজ জানান, দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার পাশাপাশি প্রথম পর্যায়ে যেসব বিষয়ের ওপর ঐকমত্য হয়েছিল, তার একটি তালিকা আগামীকাল বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে। এ ছাড়া জাতীয় সনদের খসড়ার একটি কপি ইতিমধ্যে দলগুলোকে দেওয়া হয়েছে। সংশোধনের পর আগামীকালই এ অংশটির নিষ্পত্তি করার আশা করা হচ্ছে।

আলী রীয়াজের ভাষায়, প্রায় ঐকমত্যের কাছাকাছি এসেছে কমিশন। আগামীকাল কমিশনের পক্ষ থেকে লিখিত প্রস্তাব দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো আশাবাদী যে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য সনদের পূর্ণাঙ্গ রূপ দাঁড় করাতে পারব। সব দলই কোনো না কোনোভাবে সমঝোতার দিকে এগোচ্ছে, এটি ইতিবাচক দিক।’



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button