ভারতে ব্যবসায়িক পরিবারে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব


ভারতের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী সোনা কমস্টারের প্রয়াত নির্বাহী সঞ্জয় কাপুর মারা যাওয়ার পর তাঁর মা রানী কাপুর অভিযোগ করেছেন, তাঁকে একঘরে আটকে রেখে জোর করে কাগজপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, তাঁর পুত্রবধূ প্রিয়া সাচদেব কাপুরসহ কিছু ব্যক্তি সোনা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য এসব করেছেন। তিনি বলেন, তাঁরা কাপুর পরিবারের ঐতিহ্য কেড়ে নিতে চাইছেন।
সঞ্জয় কাপুরের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সোনা কমস্টার গ্রুপ ছিল প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। কৃষি, বস্ত্র, নির্মাণ, আইটি, শিক্ষা ও জৈবপ্রযুক্তি—প্রায় সব খাতেই ছিল তাদের ব্যবসা। রানী কাপুরের দাবি, তিনি কোম্পানির বড় শেয়ারহোল্ডার হয়েও বোর্ডে প্রিয়াকে অ-নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। তিনি কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) স্থগিত করার আহ্বান জানান। তবে কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রানী কাপুর ২০১৯ সাল থেকেই আর শেয়ারহোল্ডার নন। প্রিয়া সাচদেব এই অভিযোগ নিয়ে এখনো মুখ খোলেননি।
কাপুর পরিবারের এই ঘটনা নতুন নয়। ভারতে অনেক বড় ব্যবসায়ী পরিবারেই ব্যবসার মালিকানাকে কেন্দ্র করে এমন পারিবারিক কলহ নতুন কিছু নয়—বিশেষ করে পরিবারের প্রধান মারা যাওয়ার পর।
এমনই এক নজির দেখা যায় মোদি পরিবারে। ২০১৯ সালে মোদি এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান কৃষ্ণ কুমার মোদির মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের সদস্যরা ১১ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির বণ্টনের দাবি নিয়ে আদালতে যান। উইল অনুযায়ী তাঁর স্ত্রী বীণা, দুই ছেলে সমীর ও ললিত এবং মেয়ে চারুর মধ্যে সমান ভাগে সম্পদ বিলি হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সমীর মোদি অভিযোগ তোলেন, তাঁর মা বীণা ট্রাস্টের নিয়ম ভেঙে কোম্পানির কাজকর্ম ভুলভাবে পরিচালনা করছেন। তিনি ট্রাস্ট ভেঙে দেওয়ার দাবিও জানান। শুরুর দিকে সমীর ও চারু—উভয়ে বীণার পক্ষেই ছিলেন। কিন্তু আইপিএলের প্রতিষ্ঠাতা ললিত মোদি আলাদা অবস্থান নেন। এরপর সমীর ও ললিত এক জোট হয়ে যান বীণার বিপক্ষে। যদিও কোম্পানির মূল শেয়ারহোল্ডাররা তখন বীণার পক্ষেই অবস্থান নেন এবং সমীরকে বোর্ড থেকে বাদ দেওয়া হয়।
তবুও বিবাদ থেমে থাকেনি। সমীর বা ললিত কেউই নিজেদের শেয়ার মায়ের কাছে ছাড়তে রাজি হননি, যার মানে তাঁরা পুরোপুরি হার মানেননি। মোদি পরিবারের এই বিবাদ এখন কিছুটা নিস্তেজ হয়ে আছে।
এমনই একটি গল্প আছে ওবেরয় পরিবারে। পৃথ্বী রাজ সিং ওবেরয় ছিলেন ভারতের নামকরা হোটেল ব্যবসায়ী। তাঁর প্রতিষ্ঠান ইআইএইচ লিমিটেডের মূল্য প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। ওবেরয় ও ট্রাইডেন্ট হোটেল চেইনের পেছনে ছিলেন তিনিই। ২০২৩ সালের নভেম্বরে তাঁর মৃত্যুর পর শুরু হয় পরিবারে ক্ষমতা ও সম্পদের লড়াই।
এখানে মুখ্য চরিত্র আনাস্তাসিয়া ওবেরয়—পৃথ্বী রাজের দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে। বিপরীতে আছে তাঁর সৎভাই বিক্রমজিৎ, চাচাতো ভাই অর্জুন ও নাতাশা। বিবাদের কেন্দ্রে দুটি উইল—একটি ১৯৯২ সালের, আরেকটি ২০২১ সালের এবং ২০২২ সালের একটি কোডিসিল বা সংশোধনী।
সৎভাই ও চাচাতো ভাই পুরোনো উইলকে সমর্থন করেন, আর আনাস্তাসিয়া নতুন কোডিসিলকে। কারণ, এটি তাঁর মা ও তাঁকে নির্দিষ্ট সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনীত করেছিল। আনাস্তাসিয়া অভিযোগ করেন, অন্যরা তাঁর পাওনা আটকে দিতে চাইছেন। পরে তিনি দিল্লি হাইকোর্টে গেলে কিছুটা সমঝোতা হয়। ওই বছরের শেষদিকে বার্ষিক সাধারণ সভায় সবাই অংশ নেন এবং কিছুটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের আভাস পাওয়া যায়।
ওবেরয় ও মোদি পরিবার শুধু দুটি উদাহরণ। ভারতের বড় বড় ব্যবসায়ী পরিবারে এমন অনেক বিবাদ আছে। কিছু শান্তিপূর্ণভাবে মিটে যায়, যেমন বাজাজ পরিবারে হয়েছে। ২০২২ সালে রাহুল বাজাজ মারা যাওয়ার পর তাঁর দুই ছেলে রাজীব ও সঞ্জীব কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে দ্বিধায় পড়েন। তবে তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে সমঝোতায় আসেন। কোম্পানি পুনর্গঠনের মাধ্যমে রাজীবের হাতে যায় বাজাজ অটো, আর সঞ্জীবের হাতে বাজাজ ফিনসার্ভ। এখানে তেমন নাটক হয়নি।
তবে আম্বানি পরিবারের ক্ষেত্রে নাটক ছিল চূড়ান্ত রকমের। ২০০২ সালে ধীরুভাই আম্বানি উইল না করেই মারা গেলে, তাঁর দুই ছেলে মুকেশ ও অনিলের মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তাঁদের মা কোকিলাবেন দুই ছেলেকে বসিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে দেন এবং বিশাল রিলায়েন্স সাম্রাজ্য ভাগ করে দেন।
তবুও দুই ভাই বহু বছর ধরে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে লড়াই করেছেন। কখনো ব্যবসা, কখনো সম্পদ নিয়ে। ২০১৮ সালে কিছুটা সমঝোতা দেখা যায়, মুকেশ অনিলকে প্রায় ৪১০ কোটি টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। তবুও অনিলের ভাগ্য খুব ভালো ছিল না। গত সপ্তাহেই ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগে তাঁর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) অভিযান চালিয়েছে।
পারিবারিক ঐতিহ্য আর কোটি কোটি টাকার ব্যবসা—এই দুইয়ের দড়ি টানাটানিতেই ভারতের করপোরেট দুনিয়ায় একের পর এক এমন নাটকীয় গল্প জন্ম নিচ্ছে।
তথ্যসূত্র: এনডিটিভি