নিষেধাজ্ঞার পর বৈরী আবহাওয়া, হাতিয়ার লক্ষাধিক জেলে পরিবার দুশ্চিন্তায়


বৈরী আবহাওয়ার কারণে সাগর উত্তাল থাকায় ভরা মৌসুমে মাছ শিকার করতে যেতে পারছেন না জেলেরা। অলস সময় পার করছেন নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার লক্ষাধিক জেলে পরিবার। প্রায় ১০ হাজার মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তীরে অবস্থান করছে।
জানা গেছে, এ বছর ইলিশ মৌসুমের প্রথম থেকে জেলেদের জালে তেমন একটা মাছ ধরা পড়েনি। এর মধ্যে ১৫ জুলাই পর্যন্ত ছিল গভীর সমুদ্রে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা। এরপর জেলেরা জাল নৌকা ও ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে মাছ শিকারে ব্যস্ত সময় পার করলেও আশানুরূপ মাছ জালে ধরা পড়েনি।
এদিকে গত শুক্রবার থেকে সাগরে নিম্নচাপ দেখা দেওয়ায় বৈরী আবহাওয়া বিরাজ করছে। সাগর খুবই উত্তাল হয়ে পড়েছে। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের মধ্যে টিকতে না পেরে সবাই ঘাটে চলে এসেছে।
আজ রোববার সকালে হাতিয়ার সূর্যমুখী ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্য খালের মধ্যে ছোট বড় সহস্রাধিক মাছ ধরার ট্রলার অবস্থান করছে। এ সময় কথা হয় জেলে পেশার সঙ্গে জড়িত প্রবীণ ব্যক্তি জবিয়ল হকের সঙ্গে।
জবিয়ল জানান, ৪০ বছর ধরে এই ঘাটে তাঁর বিচরণ। আগে মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখন বাড়িতে থাকেন। তবে এই ঘাটে এত নৌকা ট্রলার এক সঙ্গে খুব একটা দেখেননি। বৈরী আবহাওয়ার কারণে সবাই ঘাটে চলে এসেছেন। গত শুক্রবার সকাল থেকে এসব মাছধরা ট্রলার পর্যায়ক্রমে ঘাটে চলে আসে। সবাই অলস সময় পার করছেন। এখন ভরা মৌসুম, মাছধরার সময় সাগর উত্তাল থাকায় কেউ নদীতে যেতে পারছেন না; যা মৌসুম শেষে জেলেদের আর্থিক ভাবে বড় দেনার মধ্যে পড়তে হবে।
সূর্যমুখী ঘাটের উত্তর পাশে খাল পাড়ে দেখা হয় ভোলার দৌলতখা থেকে আসা নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৫ দিন আগে হাতিয়ার পূর্ব পাশের এই নদীতে এসেছেন মাছ ধরার জন্য। ভালো মাছ পাওয়া যায়নি। প্রতিদিন জ্বালানি তেল খরচসহ বিভিন্ন খরচ মিলিয়ে হিসাবে এখনো ঘাট আড়তে এক লাখ টাকার মতো দেনার মধ্যে আছেন। এর মধ্যে শুক্রবার ঝড়ের কবলে পড়ে ইঞ্জিনে পানি ঢুকে গেছে। অন্য একটি ট্রলারের সহযোগিতায় তীরে এসেছেন। এখন ইঞ্জিন মেরামত করে অপেক্ষা করছেন। আবহাওয়া ভালো হলে নদীতে যাবেন।
বুড়িরচর ইউনিয়নের উত্তর রেহানিয়া গ্রামের আব্দুল আলী মাঝি বলেন, নদী খুবই উত্তাল। শুক্রবার সকালে খালের মুখে ছোট ছোট তিনটি নৌকা ডুবে যায়। পরে ঘাট থেকে বড় ট্রলার গিয়ে জেলেদের উদ্ধার করে আনেন। একটি নৌকার জাল, পুলুটসহ সব ভেসে যায়। এ জন্য কোনো ট্রলার সাগরে যেতে সাহস করছে না। সূর্যমুখী ঘাটের প্রায় এক হাজার নৌকা ট্রলার ঘাটে রেখে দেওয়া হয়েছে। ট্রলারের মাঝি মল্লারা সংসারের চালাতে দেনায় জড়িয়ে পড়ছেন।
শুধু সূর্যমুখী ঘাটে নয়, একই অবস্থা উপজেলার ছোট বড় ২০টি ঘাটে। প্রত্যেকটি ঘাটে নিজস্ব ট্রলারগুলো ঘাটে অবস্থান করছে।
হাতিয়া ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি রাশে উদ্দিন বলেন, ‘গত বছর ঝড়ের কবলে পড়ে হাতিয়া বেশ কয়েকটি ট্রলার ডুবে যায়। এতে অনেকের মাঝি মাল্লা অন্য ট্রলারের সহযোগিতায় তীরে এলেও দুটি ট্রলারের পাঁচজনকে পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে নিঝুম দ্বীপ ও জাহাজমারার তিনজনের মৃতদেহ নদীতে পাওয়া যায়। এ জন্য ভয়ে এখন আর কেউ বৈরী আবহাওয়ায় নদীতে থাকতে চান না। হাতিয়ার কাটাখালী খাল বড় বড় ফিশিং ট্রলার গুলো এখানে বেশি থাকে। শুক্রবার সকাল থেকে গভীর সমুদ্র থেকে এসব ট্রলার ঘাটে ফিরে আসে। কয়েকটি ট্রলার সাগর থেকে চট্টগ্রাম চলে যায়। তবে মালিক পক্ষ থেকে এই অবস্থায় সমুদ্র না যাওয়ার জন্য সবাইকে নিষেধ করা হয়েছে।’
হাতিয়া সূর্যমুখী মাছ ঘাটের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফয়জুর রহমান নান্টু বলেন, ‘বৈরী আবহাওয়ায় সব মাছধরা ট্রলার ঘাটে। জেলেরা সবাই বাজারে ঘাটে অলস সময় পার করছেন। এতে অনেকের সংসার চালানো কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছে। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে অনেককে। ইলিশ মৌসুমের প্রথম থেকে মাছ পাওয়া যায়নি। গত কয়েক দিন আগে নদীতে কিছুটা মাছ দেখা দিয়েছে। কিন্তু এখন সাগর উত্তাল থাকায় মাছ শিকারে যাওয়া যাচ্ছে না। বৈরী আবহাওয়ায় কয়েকটি ট্রলার দুর্ঘটনার কবলে পড়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। তবে কেউ নিখোঁজ হননি।’
হাতিয়ার উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফাহাদ হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণে সাগর উত্তাল। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে জেলেদের নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে আবার সবাই মাছ ধরতে যেতে পারবেন।’