শিরোনাম

দুর্ভিক্ষে চলৎশক্তিহীন গাজাবাসী, লবণপানিই একমাত্র খাবার

দুর্ভিক্ষে চলৎশক্তিহীন গাজাবাসী, লবণপানিই একমাত্র খাবার

‘ক্ষুধার যন্ত্রণায় আমার সন্তানেরা কাঁদে। কী করব আমি? কিছুই করার নেই। বুকে জড়িয়ে ধরে বলি একদিন এই অবরোধ শেষ হবে। তখন তোমরা যা চাও, তাই খাওয়াব। কিন্তু আমি জানি এটি একটি মিথ্যা আশ্বাস, যা আমি কোনো দিনই পূরণ করতে পারব না।’ ধরা গলায় মধ্যপ্রাচ্যের সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে এসব বলেন ৩৯ বছর বয়সী আকরাম বাশীর। গাজার দেইর আল বালাহর বাসিন্দা তিনি।

শুধু তাঁর সন্তানেরাই নয়, খাবারের অভাবে নেতিয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ বাবা-মাও। ক্রমশ অবনতি হচ্ছে তাদের স্বাস্থ্যের। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ডায়বেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগী। পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে প্রায়শই তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। একবার তো পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছেন। দুধ-ডিমের মতো পুষ্টিকর খাবার ছাড়া তার সুস্থ হয়ে ওঠার কোনো উপায় নেই। কিন্তু পুষ্টিকর খাবার তো দূর কোনোমতে পেট ভরার মতো খাবারও নেই। বেশির ভাগ দিনই আমরা না খেয়ে থাকছি। মাঝে মাঝে যখন খাবার জুটছে, তাও পেট ভরার জন্য যথেষ্ট নয়। আর ওসব খাবারে পুষ্টিগুণ নেই বললেই চলে।’

শুধু আকরাম বশীর নয়, গাজার ২১ লাখ বাসিন্দার সবার দশাই এখন এমন। গত কয়েকমাস ধরে চলা ইসরায়েলি অবরোধে গাজার মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বেশির ভাগ ফিলিস্তিনিই এখন জীবন ধারণ করছে শুধু পানি আর লবণ খেয়ে!

যুক্তরাষ্ট্র, কাতারসহ অন্য মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর মধ্যস্থতায় চলতি বছর ১৯ জানুয়ারি হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। মার্চে ওই বিরতির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় দফা নিয়ে আলোচনার মধ্যেই পুরো গাজা উপত্যকা অবরোধ করে ইসরায়েলি প্রশাসন। পানি, ওষুধ, খাদ্যসহ সব ধরনের ত্রাণ প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। এর ফলে রমজানের শুরু থেকেই খাদ্যসংকট ভয়াবহ রূপ নেয়। মে মাসেই ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন’ (আইপিসি) জানায়, গাজার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ চরম দুর্ভিক্ষে ভুগছে। পরিস্থিতি এরপর আরও দ্রুত অবনতির দিকে গিয়েছে।

আকরাম বাশীর বলেন, ‘প্রথমে কিছু মজুত ছিল বলে কোনোমতে চলেছে। কিন্তু মজুত আর কত দিন চলে?’

উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের বাসিন্দা ৩২ বছর বয়সী বাসেম মুনির হিননাওয়ি বলেন, ‘গত এক মাসে আমরা চার-পাঁচ দিনে একবার রুটি খেতে পেরেছি।’ যুদ্ধের শুরুতেই নিহত হয়েছে বাসেমের বাবা। এখন নিজের স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও মা, দুই ভাই ও দুই বোনকে দেখভাল করছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘যেদিন রুটি পাই না, সেদিন ছোটদের জন্য একটুকরো বিস্কুট কিনে আনি। যদি পাওয়া যায় তাহলে কখনো কখনো ডাল সেদ্ধ খাই।’ বাসেম জানান গত মার্চের পর এখন পর্যন্ত তার ওজন কমেছে ৩৯ কেজি! জানান দুর্বলতা, মাথা ঘোরানো, হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাওয়া—এগুলো এখন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে।

খাবার সংগ্রহের চেষ্টা করতে গিয়েও বিপদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। হিননাওয়ি বলেন, ‘পাঁচবার ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে গিয়েছি, প্রতিবারই গুলি ও ড্রোনের মুখে পড়েছি। প্রতিবার খালি হাতে ফিরেছি। আল্লাহর কসম, এমন দিন গেছে যখন আমরা প্রাপ্তবয়স্করা টানা চার দিন কিছু না খেয়ে শুধু লবণ গুলে রাখা পানি খেয়ে দিন কাটিয়েছি।’

হিননাওয়ি বলেন, ‘আমরা প্রাপ্তবয়স্করা ক্ষুধা সহ্য করে নিতে পারি, কিন্তু ছোট শিশুদের কীভাবে বোঝাবো? তাদের কীভাবে বোঝানো যায় যে তাদের বাবা-মায়েরা তাদের না খাইয়ে রাখতে চায় না!’

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলি যুদ্ধ ও অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অনাহারে অন্তত ১১৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৮১ জন শিশু। অপুষ্টিতে ভুগছেন অন্তত ২৮ হাজার জন, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়।



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button