শিরোনাম
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী এক বছরে অনেক অর্জন হয়েছে: শেখ বশিরউদ্দীনজীবন আহমেদের ক্যামেরায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানর‍্যাব বলছে হত্যা, পুলিশ বলছে চুরিআল-আরাফাহ ব্যাংকে চাকরিচ্যুতদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীদের সংঘর্ষশান্ত হয়ে যাচ্ছে নীল তিমিরা, দুশ্চিন্তায় বিজ্ঞানীরাচীনের চর সন্দেহে ইন্টেল সিইওর অপসারণ চাইলেন ট্রাম্পপবিপ্রবিতে জুনিয়রকে পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়ায় ছাত্র উপ-উপদেষ্টার পদত্যাগচাঁদপুরে পিকআপ–মোটরসাইকেল সংঘর্ষে ২ শিক্ষার্থীর মৃত্যুআকাশসীমায় বেসামরিক ফ্লাইটের বিদ্যমান ঝুঁকি নিরসন করতে হবে, গোলটেবিলে বক্তারাপ্রকাশিত সংবাদ নিয়ে শিবিরের ঢাবি শাখার প্রতিবাদ

শ্রাবণধারায় রচিত এক মহাপুরুষের বিদায়

শ্রাবণধারায় রচিত এক মহাপুরুষের বিদায়

বাংলা বর্ষার দ্বিতীয় মাস শ্রাবণ। বাতাসে আর্দ্রতা, আকাশে ঘনঘোর মেঘ, আর রিমঝিম শব্দে প্রকৃতির নীরব সংগীত। এই শ্রাবণেই, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ তারিখ, আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি, বিশ্বকবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই থেকে ২২ শ্রাবণ বাঙালির জন্য শুধু এক প্রাকৃতিক ঋতুর উপলব্ধি নয়—এ এক স্মরণ, এক বিষাদ, এক চিরন্তন অভাবের দিন।

রবীন্দ্রনাথকে শুধুই কবি বললে কম বলা হয়। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, শিক্ষাবিদ, সমাজচিন্তক ও চিত্রশিল্পী। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের নির্যাস যদি কোথাও নিহিত থাকে, তবে তা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মে। আর এই মহাপুরুষের প্রয়াণ হয়েছিল যে দিনে, সেই দিনটি নিজের একটি আবহাওয়া তৈরি করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে।

অদ্ভুত বিষয় হলো, রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়, নাটকে এবং গদ্যে ‘শ্রাবণ’ নিজেই এক চরিত্র হয়ে উঠেছে। তার সৃষ্টি পড়লে বোঝা যায়, শ্রাবণ তাঁর মনে এক গভীর আবেগের ঋতু। এই ঋতু শুধু প্রকৃতির রূপবদল নয়—এ যেন হৃদয়ের এক অন্তঃসলিলা ধারা।

শ্রাবণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য আত্মিক যোগাযোগ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর অন্তত ২৪টি গানে সরাসরি শ্রাবণের নাম আছে। পাশাপাশি অসংখ্য গানে ও কবিতায় বৃষ্টি, মেঘ, বাতাস, বেদনা, বিদায়, অভিমান আর স্মৃতির যে সুর বাজে, সেখানে শ্রাবণের আবহমান ব্যাকুলতা লুকিয়ে থাকে।

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে শ্রাবণ বারবার এসেছে এক গভীর রোমান্টিক রূপ নিয়ে। তবে তা কেবল প্রেমের উচ্ছ্বাস নয়, বরং একধরনের অনাগত বিদায়ের রূঢ় বাস্তবতা। তিনি লিখেছেন: “ওগো আমার শ্রাবণ মেঘের খেয়া তরীর মাঝি/অশ্রুভরা পূরব হাওয়ায় পাল তুলে দাও আজি। ” এই পঙ্‌ক্তিতে এক বিষণ্ন যাত্রার ইঙ্গিত রয়েছে। বিদায় এখানে প্রত্যক্ষ না হলেও, বাতাসে যেন সেই বেদনার গন্ধ। পঙ্‌ক্তিগুলোর ভেতর দিয়ে একটি হাহাকার ভেসে আসে—প্রিয়জনের কাছ থেকে চিরবিদায় নেওয়ার এক অমোঘ আকাঙ্ক্ষা।

আবার অন্য এক গানে লিখেছেন: ‘এই শ্রাবণ বেলা বাদল ঝরা/যূথী বনের গন্ধে ভরা। ‘এখানে শ্রাবণ যেন রোমান্টিকতা ও প্রকৃতির সংমিশ্রণে এক স্বপ্নজ অনুভূতি। বাতাসে যূথী ফুলের গন্ধ, শ্রাবণের বৃষ্টিধারা আর প্রেমের প্রগাঢ়তা মিলেমিশে যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ কখনোই প্রেমকে নিছক আনন্দ বা উল্লাসে আবদ্ধ রাখেননি। তার প্রেমের গান, বিশেষত শ্রাবণ-ভিত্তিক গানে, বেদনা এক অনিবার্য সুর। ‘শ্রাবণ বরিষন পার হয়ে/কী বাণী আসে ঐ রয়ে রয়ে’—এই গানে শ্রাবণ যেন হয়ে ওঠে অজানা বাণীর বাহক। সে কি প্রেমের পরিণতি, না বিচ্ছেদের সান্ত্বনা? এই দ্বিধা, এই প্রশ্নই রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণগানকে করে তোলে রহস্যময় ও বহুস্তরবিশিষ্ট।

শ্রাবণের ধারা রবীন্দ্রনাথের গানে শুধুই প্রকৃতির উপমা নয়। তা হয়ে ওঠে প্রতীক্ষার প্রতীক। ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে/ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে। ‘এখানে শ্রাবণ যেন বাহ্যিক প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং মনের দোলাচল, জীবনের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ার এক অজানা উদ্দীপনা। এই দ্বিধা, এই চেতনা—প্রকৃতি আর মানুষের এক আশ্চর্য সাযুজ্য, যা কেবল রবীন্দ্রনাথের কলমেই সম্ভব। শ্রাবণ এখানে নেমেছে ‘জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার’ দূত হয়ে। বৃষ্টি যেমন ঝরে আর থেমে যায়, মানুষও তেমনি একসময় সব ছেড়ে চলে যায়। ‘গহন রাতে শ্রাবণ ধারা পড়িছে ঝরে’—এই পঙ্‌ক্তির নির্জনতায় যেন মৃত্যুর ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টিকে দেখেছেন রূপের শিল্পী হিসেবে। তাঁর গানে শ্রাবণ মানেই কেবল জলধারা নয়, বরং আলো-আঁধারির খেলা, বিদ্যুৎ চমক, অদ্ভুত কল্পনায় মেঘের নাচন। ‘শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়’—এই পঙ্‌ক্তিতে শ্রাবণ যেন রোমাঞ্চকর এক দৃশ্যপট। আরেক গানে তিনি বলেন: ‘পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণ গগন অঙ্গনে। ‘মেঘ এখানে শুধু প্রকৃতির উপাদান নয়, বরং এক যাযাবর দলে পরিণত হয়েছে, যাদের কোনো গন্তব্য নেই। যেন মানুষ নিজেই মেঘ হয়ে গেছে, ভেসে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দেশে।

১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ, ইংরেজি ৭ আগস্ট ১৯৪১—এই দিনটিতে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আশ্চর্য এই যে, যাঁর কবিতায়, গানে, গদ্যে শ্রাবণ এসেছে বিচ্ছেদ, প্রত্যাশা, বিষাদ ও আলোড়নের প্রতীক হয়ে—শেষ পর্যন্ত তিনিই যেন নিজেকে সেই শ্রাবণের মাঝেই বিলীন করলেন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ পর্বে অসুস্থতা, দেশ বিভাজনের আশঙ্কা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে চরম বিষাদে নিমজ্জিত ছিলেন। তাঁর শেষ দিককার কবিতাগুলোতে আমরা সেই বিষণ্নতা অনুভব করি। মৃত্যুর পূর্বে তিনি লিখেছিলেন: ‘মৃত্যুরে করিতে পারি অহো রে জয়/জয়িনী তোরে নয়/মৃত্যুরে আমি করেছি অমৃতস্য সন্তান। ‘এই উক্তির মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস, তা যেন বৃষ্টির মধ্যেও রোদ উঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২২ শ্রাবণ তাই শুধুই অন্তিম নয়, তা আশ্বাসেরও দিন।

প্রতি বছর ২২ শ্রাবণ এলে বাঙালির হৃদয়ে কেবল শোক নয়, একধরনের আধ্যাত্মিক কম্পন জেগে ওঠে। আমরা যেন এই দিনটিতে একটু বেশি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি, তাঁর গান শুনি, কবিতা পড়ি, একটু শান্ত হয়ে যাই। এই দিনে অনেকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তো কখনো মরেননি। ‘কথাটি আক্ষরিক অর্থে নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক দিক থেকে একেবারে সত্য। তিনি আজও আমাদের গান, নাটক, চিত্রকলা, চিন্তা ও চেতনায় জ্যোতিষ্ক হয়ে আছেন।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে বৃষ্টিকে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে বিষাদকে মেনে নিতে হয়, কীভাবে প্রেমকে পূর্ণতার মতো ধরতে হয়, আবার মুক্তির মতো ছেড়ে দিতে হয়। তাঁর শ্রাবণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবন অনিশ্চিত, তবু তা সুন্দর। বেদনার মধ্যেই থাকে সৌন্দর্যের আলো। আর এই সৌন্দর্য খোঁজার জন্যই আমরা বারবার ফিরে যাই তাঁর গানে, কবিতায়, সাহিত্যে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ‘শ্রাবণ’কে রূপ দিয়েছেন এক জীবন্ত রূপকে। বাংলা সাহিত্যে ‘শ্রাবণ’ এখন কেবল একটি ঋতু বা মাস নয়—এ এক অনুভূতি, এক ভাষা, এক চেতনা। ২২ শ্রাবণ তাই আমাদের জন্য এক দ্বৈততার দিন—বিষাদের এবং ভালোবাসার, অভাবের এবং প্রাপ্তির, মৃত্যুর এবং অমরতার। এই দিনটিতে আমরা কেবল একটি মানুষকে স্মরণ করি না; আমরা স্মরণ করি একটি ভাবধারা, একটি কাব্যিক দর্শন, একটি জাতির আত্মপরিচয়।

এই লেখা শেষ করি রবীন্দ্রনাথের এক শ্রাবণঘন গান দিয়ে: ‘সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা/অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশ হারা। ‘কিন্তু আমরা জানি—এই অন্ধকার বিভাবরীতেও রবীন্দ্রনাথ আছেন। তিনি সঙ্গ পরশ হীন হননি। তিনি বরং আমাদের হৃদয়ে শ্রাবণ হয়ে ঝরে পড়ছেন, চিরকাল।



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button