আকাশসীমায় বেসামরিক ফ্লাইটের বিদ্যমান ঝুঁকি নিরসন করতে হবে, গোলটেবিলে বক্তারা


যাত্রীদের শতভাগ নিরাপত্তা হচ্ছে বেসামরিক বাণিজ্যিক ফ্লাইটগুলোর অন্যতম অগ্রাধিকার। তবে বাংলাদেশের আকাশসীমায় বেসামরিক ফ্লাইটগুলো চলাচলের ক্ষেত্রে কিছু ঝুঁকি রয়েছে। এ ঝুঁকিগুলো নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) বিকেলে অ্যাভিয়েশন খাত নিয়ে এক গোলটেবিলে বক্তারা এমন কথা বলেন।
মাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজধানীর একটি হোটেলে ‘অ্যাভিয়েশন খাতে জরুরি অবস্থা এবং নাগরিক ঝুঁকি: বাংলাদেশে দুর্যোগ প্রস্তুতির পুনর্বিবেচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে অ্যাভিয়েশন খাতের পত্রিকা দ্য বাংলাদেশ মনিটর ও শেরাটন ঢাকা। গোলটেবিল সঞ্চালনা ও মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দ্য বাংলাদেশ মনিটরের সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম।
বাংলাদেশের আকাশসীমার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হলো বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। এ বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও তা পালনের জন্য যথেষ্ট সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে কি না, এ বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) মফিজুর রহমান।
সামরিক ও বেসামরিক এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে মফিজুর রহমান বলেন, ‘এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কী হবে, তা সুনির্দিষ্ট। দুঃখজনকভাবে সামরিক ও বেসামরিক উড়োজাহাজের সহযোগিতা কীভাবে হবে, তা নেই। শান্তির সময় বেসামরিক উড়োজাহাজ অগ্রাধিকার পাবে, আর যুদ্ধের সময় সামরিক। যদিও আমাদের অভ্যাস হলো, সামরিক বিমানগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের লম্বা লাইন হয়ে গিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের অবতরণের সময় নিয়ম অনুযায়ী অন্য উড়োজাহাজের সঙ্গে কমপক্ষে ১ হাজার ফুট উচ্চতা দূরত্ব থাকার কথা। এমন অনেকবার হয়েছে, বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ ১ হাজার ফুটে রয়েছে, আর সামরিক বিমান এত কাছে চলে আসে যে, উচ্চতা দূরত্ব ৫০০ ফুট হয়। বাণিজ্যিক উড়োজাহাজে একটি নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে, যাতে অন্য কোনো উড়োজাহাজ যদি তার কাছাকাছি চলে আসে, ঝুঁকি বিবেচনায় উড়োজাহাজটি পাইলট থেকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উচ্চতা অর্জন করতে থাকে। এমন ঘটনা ডজনের ওপর ঘটেছে।’
মফিজুর রহমান বলেন, ‘যখন আমাদের বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ নকশা তৈরি করা হয়েছিল। তখন আমাদের আকাশসীমায় বাণিজ্যিক ফ্লাইট কম ছিল। এখন সময় এসেছে এ নকশাগুলো নতুন করে তৈরি করার। ঢাকা থেকে কক্সবাজার বাণিজ্যিক ফ্লাইট রুটের পাশে বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ রুট রয়েছে। যার কারণে বেশ কয়েকবার সামরিক ট্রাফিকের সঙ্গে বাণিজ্যিকের ঝামেলা হয়েছে। প্রায় ১৫ মাইল ঘুরে বাণিজ্যিক ফ্লাইটগুলোকে যেতে হয়। একই অবস্থা সৈয়দপুরের ফ্লাইটের ক্ষেত্রেও হয়। এতে অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করতে হয়, খরচ বাড়ায় ও কার্বন নিঃসরণ বাড়ায়। সংশ্লিষ্টদের বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনায় নিতে হবে।’
বক্তারা বলেন, ‘মাইলস্টোন ঘটনা আমাদের জন্য একটি বার্তা দিয়ে গিয়েছে। দুর্ঘটনা ঘটতে না দেওয়াটা আমাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। আর যদি ঘটে যায়, তাহলে কী করতে হবে, সে বিষয়টি আমাদের চিন্তা করতে হবে। যদি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে দুর্ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রে জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হবে। বাণিজ্যিক উড়োজাহাজগুলোর অন্যমত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ করা। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শতভাগ ঝুঁকি নিরসনের বিষয়গুলো আমলে নিতে হবে। দুর্ঘটনা ঘটার আগে আগাম প্রস্তুতি থাকা উচিত।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কারিগরি বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন তানভির খুরশিদ বলেন, ‘সামরিক ফ্লাইটের কারণে বাণিজ্যিক ফ্লাইটের ঢাকা থেকে উড্ডয়নের সময়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপেক্ষা করতে হয়। এর কারণে বিদেশে আমাদের অবতরণের স্লট হারিয়ে ফেলার মতো সমস্যায় পড়তে হয়। অনেক সময় আমরা অতিরিক্ত তেল রাখি না, এ ধরনের অপেক্ষা আমাদের সমস্যায় ফেলে। যখন সামরিক ফ্লাইটগুলো শুরু হয়, তখন আগাম কোনো বার্তা আমরা পাই না। ফলে বেশির ভাগ সময়ে ট্যাক্সিপথে বসে থাকতে হয়। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে এবং প্রশিক্ষণ তো হবেই। তবে মাথায় রাখতে হবে, এ ধরনের ঘটনা যাত্রীদের জন্য বিরক্তিকর। বিষয়টি আমাদের উদ্বেগের।’
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এয়ার কমোডর (অব.) ইসফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের এখন চিন্তা করতে হবে, শহরের বাইরে গিয়ে কোথায় আমরা ফ্লাইটের প্রশিক্ষণ দিতে পারি। সবকিছু আমাদের ভেবেচিন্তে পরিকল্পনামাফিকভাবে কাজ করতে হবে।’
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সাবেক নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম বলেন, ‘সিভিল অ্যাভিয়েশনের নিয়ম অনুসরণ করে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনার পর ট্রাফিকের কারণে অনেক কিছু করতে বেশ কিছু সময় লেগেছে। তারপরেও সবাই সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার ২৪ ঘণ্টা নিয়োজিত থাকে।’
এয়ার কমোডর এ কে এম জিয়াউল হক বলেন, সিভিল অ্যাভিয়েশনের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে এমওইউয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যা বর্তমানে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। ফলে দুর্ঘটনা ও ইমার্জেন্সি অবস্থায় কার কী করণীয়, কী করতে হবে, সেসব বিষয়ে বিস্তারিত থাকবে।
ক্যাপ্টেন (অব.) সালাউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ বলেন, দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা অন্য শিক্ষার্থীরা কোনো দিন তাদের এই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারবে না। বিমানবন্দরের পাশে স্কুল কলেজ কোনোভাবেই গড়ে ওঠা ঠিক হয়নি, যারা অনুমোদন দিয়েছে তারাও ঠিক করেনি।
অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড টুরিজম জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের (এটিজেএফবি) তানজিম আনোয়ার বলেন, ‘দুর্নীতি করে বিমানবন্দর এলাকায় এসব স্থাপনা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। সিভিল অ্যাভিয়েশন কী করল, তারা তো ব্রিফ করে বলল না, এখানে যেসব অবৈধ ভবন রয়েছে সেসবের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিব। এভাবে অবৈধভাবে অনুমোদন দেওয়া আর কত দিন চলবে। এগুলো বিষয়ে নজরদারি করা এবং ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এমন ঘটনা থেমে থাকবে না।’
বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নিই, বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে আমরা তেমন কোনো প্রস্তুতি গ্রহণ করি না, সেভাবে ভাবিও না। এগুলো নিয়ে ভাবার এবং কর্মপদ্ধতি কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করার সময় এসেছে। যা আমাদের যুগোপযোগী করে সাজাতে হবে। জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমানবন্দর বিষয়টিও আমাদের সমস্যা বাড়ায়। আকাশে ফ্লাইট যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে ১০ বছর পরেই এমন স্থানে বিমানবন্দর রাখা কঠিন হয়ে যাবে, সরিয়ে নড়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। তাই ভবিষ্যতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করা উচিত।’
এতে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক সহকারী প্রধান এয়ার কমোডর (অব.) শফিকুল ইসলাম, সাবেক উইং কমান্ডার এটিএম নজরুল ইসলাম, এয়ার অ্যাস্ট্রার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আসিফ, নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব, কর্নেল (অব.) মো. সোহেল রানা, ইউনিক হোটেলস অ্যান্ড রিসোর্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেনসহ প্রমুখ।