শান্ত হয়ে যাচ্ছে নীল তিমিরা, দুশ্চিন্তায় বিজ্ঞানীরা


বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাণী নীল তিমি, আগের মতো আর গান গাইছে না। এই নীরবতা বিজ্ঞানীদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে সমুদ্রের তলদেশে বসানো একটি হাইড্রোফোনে (ধ্বনি সংগ্রাহক যন্ত্র) ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নীল তিমির গানের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
এই গবেষণাটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে প্লস জার্নালে। এতে দেখা গেছে, ২০১৩ সাল থেকে একটি অস্বাভাবিক সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ শুরু হয়। বিজ্ঞানীরা এই তাপপ্রবাহের নাম দিয়েছেন ‘দ্য ব্লব’। এই ব্লব প্রশান্ত মহাসাগরের তাপমাত্রা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে সমুদ্রে ক্রিল নামে ক্ষুদ্র এক প্রজাতির চিংড়ি সদৃশ প্রাণীর পরিমাণ নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। আর এই ক্রিলই নীল তিমির প্রধান খাদ্য।
‘দ্য ব্লব’ নামের তাপপ্রবাহটি প্রথমে বেরিং সাগর ও আলাস্কা উপকূল থেকে শুরু হয়ে উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ধেয়ে এসেছিল। কিছু অঞ্চলে এটি সাগরের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ৪.৫ ফারেনহাইট বেশি ছিল। ২০১৬ সালের মধ্যে এই উষ্ণ জলরাশি প্রশান্ত মহাসাগরের প্রায় ২ হাজার মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হয়।
এই অতিরিক্ত উষ্ণতা বিষাক্ত শৈবাল উৎপন্ন করে। এর ফলেই মূলত সমুদ্রের অন্যান্য কিছু প্রাণীর সঙ্গে সঙ্গে ক্রিলের সংখ্যাও কমিয়ে দেয়। ফলে নীল তিমিরা পর্যাপ্ত খাবার না পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। তারা আর আগের মতো গান গাইতে পারে না।
মন্টেরি বে অ্যাকুয়ারিয়াম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জীববিজ্ঞানী জন রায়ান ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-কে বলেন, ‘ক্ষুধার্ত অবস্থায় গান গাওয়া খুব কঠিন। তিমিরা তখন শুধুই খাবারের খোঁজে ছুটছে। গান গাওয়ার সময় বা শক্তি তাদের নেই।’
গবেষণায় দেখা গেছে, ছয় বছরের মধ্যে তিমির গানের হার প্রায় ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। গবেষণার সহলেখক ও সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী কেলি বেনোয়া-বার্ড বলেন, ‘এই উষ্ণ বছরগুলোতে শুধু তাপমাত্রাই নয়, পুরো সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র বদলে যায়। তখন ক্রিল জন্মায়নি। আর যারা শুধু ক্রিলের ওপর নির্ভর করে—তাদের সামনে কোনো পথ খোলা থাকে না।’
পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলেই আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীদের। কারণ, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের মহাসাগরগুলো ইতিমধ্যে অতিরিক্ত তাপের ৯০ শতাংশেরও বেশি শোষণ করছে। এর ফলে ক্রিলের মতো সূক্ষ্ম প্রাণীর বিলুপ্তি শুধু নীল তিমিই নয়, পুরো সামুদ্রিক খাদ্যচক্রকে বিপন্ন করে তুলছে।
তিমিদের এই নীরবতা তাই শুধু একটি প্রজাতির দুর্ভোগ নয়—এটি সমুদ্রের গভীরে চলা এক মহা সংকটের স্পষ্ট ইঙ্গিত।