শিরোনাম

বন্ধুত্ব আসলে কী, কে আপনার সেরা বন্ধু

বন্ধুত্ব আসলে কী, কে আপনার সেরা বন্ধু

‘পুরো পৃথিবী এক দিকে আর তোরা অন্যদিক

সবাই বলে করছ ভুল আর তোরা বলিস ঠিক

তোরা ছিলি, তোরা আছিস, জানি তোরাই থাকবি

বন্ধু—বোঝে আমাকে’

রাশেদ উদ্দিন আহমেদ তপুর এই গানে খুব সহজে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘বন্ধু’ কী। ছোট্ট একটা শব্দ কিন্তু গভীরতা বিশাল। কারও সঙ্গে এক কাপ চায়ের আড্ডা, ক্লান্ত দুপুরে একটুখানি বোঝাপড়া, কিংবা মন খারাপের সময় নিঃশব্দে পাশে বসে থাকার মতো কিছু মুহূর্ত—মোট কথা একটা মানুষের সঙ্গে যে আত্মিক সম্পর্ক, তা-ই বন্ধুত্ব।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, বন্ধুত্ব শুধু পারস্পরিক ভালোবাসা নয়, বরং এটি নির্ভরতা ও স্বতঃস্ফূর্ত আন্তঃসম্পর্কের এক জটিল বিন্যাস। নর্দার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ও বন্ধুত্ব-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. সুজান ডেগস-হোয়াইট বলেন, বন্ধুত্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান হলো পারস্পরিক নির্ভরতা ও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ইচ্ছা। তিনি বলেন, ‘সত্যিকারের বন্ধুত্ব তখনই গড়ে ওঠে, যখন উভয়েই একে অপরের চিন্তা, অনুভূতি ও জীবনবোধের প্রতি আগ্রহ দেখায়।’ অর্থাৎ, বন্ধুত্ব একতরফা নয়, এটি গড়ে ওঠে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং আবেগ ও সহায়তার আদান-প্রদানের মাধ্যমে।

তবে, বন্ধুত্বের এই সুন্দর গাঁথুনি কিন্তু মুহূর্তেই তৈরি হয় না। গবেষণা বলছে, কমপক্ষে ২০০ ঘণ্টা একসঙ্গে কাটানোর পর দুজন সাধারণ পরিচিত মানুষ ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন। প্রথমে হয়তো ৫০ ঘণ্টায় একজন পরিচিত মানুষ ‘বন্ধু’ হয়ে ওঠেন, এর পরবর্তী ৯০ ঘণ্টায় সম্পর্ক কিছুটা গভীর হয়। আর দীর্ঘ সময়ের নিরবচ্ছিন্ন আদান-প্রদানে তৈরি হয় ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’—যার সঙ্গে আপনি মনের সব কথা নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে ভাগ করে নিতে পারেন।

একই পেশায় কাজ করা, একই বয়স বা জীবনের একই পর্যায়ে থাকা, কিংবা একই সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসাসহ নানা প্রেক্ষাপটে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে। অনেক সময় বন্ধুত্ব হয় ধীরে ধীরে, আবার কখনো ঘটে হঠাৎ। ড. ডেগস-হোয়াইট বলেন, ‘আপনি হয়তো কোনো একটা গ্রুপের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট একজনের সঙ্গে মুহূর্তে বেশি সখ্য গড়ে উঠল। এটা অনেকটা প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো। কিন্তু এখানে কোনো রোমান্সের অনুভূতি নেই।’ তিনি জানান, একে বলে ‘ক্লিকিং ফেনোমেনন’।

বন্ধুত্ব শুধু মানসিক শান্তিই দেয় না, বরং এটি আমাদের সামগ্রিক সুখ ও স্বাস্থ্যেও গভীর প্রভাব ফেলে। ২০১৭ সালে পার্সোনাল রিলেশনশিপস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, বার্ধক্যে মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতায় পরিবারের চেয়েও প্রকৃত বন্ধুত্ব বেশি প্রভাব রাখে। ভালো বন্ধুদের উপস্থিতি মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করে, চাপ কমায় এবং জীবনকে আরও অর্থবহ মনে করায়। বিশেষ করে যখন জীবনে কোনো খারাপ সময় আসে, যেমন—প্রিয়জন হারানো, অসুস্থতা বা বিচ্ছেদ, তখন এই বন্ধুরাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় ভরসা।

বন্ধুত্বের ধরনও কিন্তু এক রকম নয়। গবেষকেরা বলেন, কেউ কেউ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একটি দল নিয়ে জীবন সাজান, আবার কেউ আলাদা আলাদা জীবনপর্যায়ের বন্ধুদের আলাদা বলয়ে রাখেন। কেউ আবার কেবল একজন একান্ত বন্ধুতে সীমাবদ্ধ থাকেন, কোনো গ্রুপের সঙ্গে মেলামেশা এড়িয়ে চলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বৈচিত্র্যই প্রমাণ করে, বন্ধুত্ব একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। এটি মানুষের মনের গঠন, অভিজ্ঞতা ও সামাজিক চাহিদার ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে।

ড. ডেগস-হোয়াইট বন্ধুত্বকে চারটি ভিন্ন ধরনে চিহ্নিত করেছেন—পরিচিত, বন্ধু, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সেরা বন্ধু। তাঁর মতে, যাদের সঙ্গে রোজ দেখা হয়, কুশল বিনিময় হয়, কিন্তু গভীর কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না তিনি কেবল ‘পরিচিত’। আর যাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে সময় কাটায়, আড্ডা দেয় বা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে একত্রিত হয়, তাদের শুধু ‘বন্ধু’ বলা যেতে পারে। এর পরের ধাপ হলো ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’। যাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয় ভাগ করা হয়, দুঃসময়ে যারা পাশে থাকবে বলে আশা করা যায়, সর্বোপরি যাদের ওপর নিঃশর্ত আস্থা থাকে তারা ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’।

ড. ডেগসের মতে, বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে ‘সেরা বন্ধু’ বা বেস্ট ফ্রেন্ড। যে আপনার মন বোঝে, পছন্দ-অপছন্দ বোঝে, দীর্ঘদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পরও দেখা বা কথা হলে অস্বস্তিবোধ হয় না, সবকিছু একই রকম লাগে—সেই বন্ধুরাই ‘সেরা বন্ধু’।

আজ আগস্ট মাসের প্রথম রোববার—আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস। শুভেচ্ছা জানান আপনার বন্ধুদের। নিজেও হয়ে উঠুন কারও ‘সেরা বন্ধু’।



আরও দেখান
Back to top button