এক ইঞ্চি মাটিও ছাড়বে না থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া, কিন্তু যুদ্ধ চালানোর সক্ষমতা কতটুকু


থমথমে পরিবেশ, থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে ট্যাঙ্কের গর্জন আর কামানের শব্দ—তিন দিন ধরে থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর পরিস্থিতি এরকমই। দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সীমান্ত দ্বন্দ্ব অবশেষে রূপ নিয়েছে খোলা সংঘর্ষে। গত বৃহস্পতিবার প্রতিবেশী কম্বোডিয়ার সঙ্গে পাল্টাপাল্টি গোলাগুলি শুরুর পর থেকে এটাই যেন হয়ে উঠেছে সীমান্তের সাধারণ দৃশ্য। তিন দিনের এই গোলাগুলিতে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩৩ জন। চলমান এই সংঘাতে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন দেড় লাখের বেশি মানুষ। পরিস্থিতি এখনও উত্তপ্ত।
গতকাল শনিবার সিসাকেট প্রদেশের সীমান্তঘেঁষা এক অস্থায়ী সেনাঘাঁটি থেকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফকে সাক্ষাৎকার দেন লেফটেন্যান্ট নিতিপন। গোলাগুলির গর্জনের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “চারপাশে এখন শুধু কামান আর রকেট লঞ্চারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দুদিক থেকেই গোলা আসছে।’
মন খারাপ নিয়ে নিতিপন জানান তিনি প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ চান না। সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে দেশকে সুরক্ষা দেওয়া তাঁর দায়িত্ব। আর সেটিই তিনি করছেন। টেলিগ্রাফকে তিনি বলেন, ‘একজন সেনা হিসেবে এটি আমার দায়িত্ব, আর আমি গর্বের সঙ্গেই তা পালন করছি। কিন্তু সত্য বলতে, আমি চাই না এই যুদ্ধ চলতে থাকুক। কারণ এতে কেবল ক্ষতি হয়। সবারই ক্ষতি হয়।’
সিসাকেট শহর এখন কার্যত জনশূন্য। যেসব দোকান সাধারণত সবসময় খোলা থাকে, সেগুলোতে বন্ধ রয়েছে। ফাঁকা রাস্তায় ছুটছে শুধু সেনাবাহিনীর ট্রাক। সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিম দিকের উপকূলবর্তী এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে সংঘর্ষ। থাই নৌবাহিনীও এতে অংশ নিয়েছে। যুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান, ড্রোন, এবং রকেট লঞ্চারের মতো ভারী অস্ত্র।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ শুক্রবার জরুরি বৈঠক ডেকেও সংঘর্ষ থামাতে পারেনি। দুই দেশের কেউই আপস করতে রাজি নয়। থাইল্যান্ড চাইছে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা, কিন্তু কম্বোডিয়া আন্তর্জাতিক সালিসের পক্ষে। উভয় পক্ষই একে অপরকে বেসামরিকদের লক্ষ্য করে হামলা চালানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করছে।
থাইল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএসইএএসের (ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউট) বিশ্লেষক টিটা সাংলি মনে করেন, ‘যুদ্ধের মাধ্যমে কৌশলগতভাবে কম্বোডিয়ার সামরিক সক্ষমতাকে দুর্বল করতে চাইছে থাই সেনাবাহিনী, যেন আলোচনায় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারে তারা।’
এই সীমান্ত দ্বন্দ্বের মূল শিকড় ঔপনিবেশিক আমলের মানচিত্র। বহু আগে থেকেই প্রাচীন মন্দির এবং সীমান্ত রেখা নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। ১৪-১৫ শতকে আধুনিক থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার অনেক অংশ শাসন করত খেমার সাম্রাজ্য। সাম্রাজ্য পতনের পর থাই ও ভিয়েতনামি রাজ্যগুলো খেমার ভূখণ্ড দখল করতে থাকে। ১৮৬৩ সালে ফ্রান্স যখন কম্বোডিয়াকে উপনিবেশ বানায়, তখন একাধিক চুক্তির মাধ্যমে থাইল্যান্ড (তৎকালীন শ্যাম) বাতামবাং, শ্যাম রিয়াপসহ একাধিক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে বাধ্য হয়। ১৯০৭ সালে ফরাসিরা যে মানচিত্র তৈরি করে, সেটিই আজকের সীমান্তের ভিত্তি।
ওই মানচিত্রে প্রিয়াহ ভিহিয়ার মন্দিরকে কম্বোডিয়ার ভূখণ্ডে দেখানো হয়। তৎকালীন শ্যাম (বর্তমান থাইল্যান্ড) সেই মানচিত্রে সম্মতি দিলেও পরে তারা মত পাল্টায়। তাদের দাবি, তারা ভেবেছিল প্রাকৃতিক জলবিভাজিকা (নদী বা খাল) ধরে সীমান্ত নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু পরে তারা বুঝতে পারে, ফ্রান্সের মানচিত্রে প্রাকৃতিক জলবিভাজিকা মানা হয়নি।
এই বিরোধ গড়ায় আদালত পর্যন্ত। ১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) কম্বোডিয়ার পক্ষে রায় দেন। থাইল্যান্ড ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে এই মানচিত্র থাইল্যান্ড একসময় স্বীকার করেছিল উল্লেখ করে সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন আদালত। থাইল্যান্ডকে বিরোধপূর্ণ ওই এলাকা থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ১৯৫৪ সালের পর মন্দির এলাকা থেকে কোনো প্রত্ন নিদর্শন নিয়ে থাকলে তা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
তবে পরবর্তী দশকে আবারও উত্তেজনা বাড়ে। ২০১৩ সালে আইসিজে আগের রায়ের ব্যাখ্যা দিয়ে জানান, শুধু মন্দির নয়, মন্দিরের আশপাশের এলাকাও কম্বোডিয়ার অন্তর্ভুক্ত। সেই সঙ্গে আদালত থাইল্যান্ডকে ওই এলাকা থেকেও সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। তবে থাইল্যান্ড সেই রায় এখনো মেনে নেয়নি।
২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত দুদেশের সংঘাতে যে পরিমাণ প্রাণহানি হয়েছিল এবারের সংঘাতে প্রাণহানির সংখ্যা তা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই সংঘাতে ২০ জন নিহত হয়েছে, কম্বোডিয়ায় প্রাণ গেছে ১৫ জনের। সব মিলিয়ে দুই দেশে বেসামরিক প্রাণহানির সংখ্যা ২১, যার মধ্যে রয়েছে আট বছর বয়সী এক শিশুও। থাইল্যান্ডে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার বাসিন্দাকে আর কম্বোডিয়ায় বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৩৫ হাজার।