সংসার চালানো কষ্ট হলেও বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছেন চাটমোহরের শাঁখারিরা


স্বামীর মঙ্গলের জন্য সনাতন ধর্মাবলম্বী নারীরা ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ের সাত পাকে বাঁধার সময় থেকে হাতে শাঁখা পরে থাকেন। পাবনার চাটমোহরের হান্ডিয়াল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম ডেফলচরায় শাঁখারিরা শাঁখা বানান। কাটা শঙ্খ থেকে শাঁখা তৈরি ও নকশা করেন তাঁরা। যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় এ কাজ করে আসছেন তাঁরা। জীবন ও জীবিকার তাগিদে তাঁদের কেউ কেউ এখন অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। আবার অনেকে কষ্ট হলেও বাপ-দাদার এই পেশাকে ধরে রেখেছেন।
চাটমোহর পৌর সদর নতুন বাজার হতে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে ডেফলচরা গ্রামের অবস্থান। বহুকাল ধরে এ গ্রামে বসবাস করে আসছেন শঙ্খশিল্পের সঙ্গে যুক্ত শাঁখারিরা। বর্তমানে এই গ্রামে ৩৭টি শাঁখারি পরিবারের বসবাস। এর মধ্যে ৩০টি পরিবার শাঁখাশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। আর অন্য পরিবারগুলো পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
শাঁখারিরা বলছেন, গত ১০ থেকে ১৫ বছরে শঙ্খের দাম বেড়েছে ৪ থেকে ৫ গুণ। কাঁচামালের দাম বাড়ার ফলে ক্রেতারা শাঁখা কিনতে চান না। ফলে শাঁখারিদের লোকসান হয়। অভাবের কারণে দরিদ্র শাঁখারিরা মহাজনের কাছে কম দামে শাঁখা বিক্রি করতে বাধ্য হন। এ কাজের জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে সহজে ঋণও পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি টানতে টানতে দিশাহারা হয়ে পড়েন তাঁরা এবং একসময় ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন। জীবন ও জীবিকার তাগিদে অনেকে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা দরকার বলে মনে করেন তাঁরা।
এ গ্রামের শাঁখারি বিকাশ কুমার ধরের স্ত্রী সিমা রানী ধর (৩৫) আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর বিয়ে হয়। বিয়ের আগে বাবা-মায়ের কাছে শাঁখায় নকশার কাজ করা শিখি। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে এসে এ কাজই করছি। সকাল থেকে রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত বাড়ির কাজের পাশাপাশি শাঁখায় নকশা তৈরি করি।’ বিভিন্ন আকারের রেত দিয়ে ঘষে প্রতিদিন চিকন প্রায় ৩০ জোড়া আর মোটা শাঁখা হলে ২৫ জোড়া তৈরি করা যায় বলে তিনি জানান।
শাঁখারি বাবলু কুমার ধর বলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষেরাও এ পেশায় ছিলেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে শঙ্খ কাটা অবস্থায় আমাদের দেশে আসে। কাটা শঙ্খ ইলেকট্রিক মোটরের সাহায্যে ফিনিশিং করে আনি। এ জন্য মোটরমালিককে জোড়াপ্রতি ২০ টাকা করে দিতে হয়। এরপর বাড়ির মহিলারা হাতে নকশা তৈরির কাজ করে। পরে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে শাঁখা বিক্রি করি। নকশা ও গুণগত মান অনুযায়ী ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যায়। তবে শঙ্খের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সবশেষে আমাদের বেশি টাকা থাকে না। যে টাকা হয়, তা দিয়ে সংসার চালানোই মুশকিল। বাপ-দাদার ব্যবসা এটি। এ জন্য এখনো করছি। তা না হলে কবেই এ ব্যবসা ছেড়ে দিতাম।’
একই গ্রামের মধুসূদন সেন বলেন, ‘একসময় শাঁখায় নকশা করে বিক্রি করতাম। এক বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলাম। ঋণের টাকা শোধ করতে গিয়ে টাকার অভাবে ব্যবসা বাদ দিয়ে দিয়েছি। আমার পূর্বপুরুষেরা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভালোবাসার কারণে এখনো অন্য পেশায় যেতে পারি নাই। এখন মজুরির ভিত্তিতে মহাজনের কাজ করে দেই। আমরা যান্ত্রিক মোটরের সাহায্যে মহাজনের শাঁখা ফিনিশিংয়ের কাজ করি। পরে তাঁরা সেই শাঁখায় নকশা করে বিক্রি করেন।’
এ ব্যাপারে চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোসা. নাসের চৌধুরী বলেন, ‘প্রাচীন এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারিভাবে ক্ষুদ্র ঋণেরও ব্যবস্থা করব।’