৬০ থেকে ৮৬, যেভাবে বাড়ল সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের গড় আয়ু


দীর্ঘ জীবনের কথা উঠলে সাধারণত গ্রিসের ইকারিয়া, জাপানের ওকিনাওয়া, কোস্টারিকার নিকোয়া কিংবা ইতালির সার্দিনিয়ার নাম শোনা যায়। এই জায়গাগুলোকে বলা হয় বিশ্বের ‘ব্লু জোন’। এসব জায়গার মানুষ অন্য যেকোনো জায়গার তুলনায় বেশি দিন বাঁচে। শুধু তা-ই নয়, সুস্থভাবে বাঁচে। ২০২৩ সালের আগস্টে এই তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয় সিঙ্গাপুর। আর সেটিই বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বিশ্ববাসীর। কারণ, এটি বিশ্বের ষষ্ঠ ব্লু জোন এবং প্রথম ‘ব্লু জোন ২.০’।
অন্য ব্লু জোনগুলোতে মানুষ দীর্ঘ জীবন পেয়েছে মূলত তাদের উন্নত জীবনযাপন, স্বাস্থ্যকর খাবার আর ইতিবাচক সমাজব্যবস্থার জন্য। ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সুস্থ জীবনযাপন করছে। কিন্তু সিঙ্গাপুরের প্রসঙ্গটা ভিন্ন। সেখানে মানুষের দীর্ঘায়ুর কারণ সরকারের স্বাস্থ্যনীতি, নগর-পরিকল্পনা আর পরিবেশ রক্ষার মতো বিষয়গুলোতে বিনিয়োগের ফল।
স্বাধীনতার পর থেকে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন
১৯৬০ সালে সিঙ্গাপুরে জন্ম নিলে একজন মানুষের গড় আয়ু হতো মাত্র ৬৫ বছর। কিন্তু স্বাধীনতার ৬০ বছর পর এখন দেশটির মানুষের গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৬ বছরে। শুধু তা-ই নয়, ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ সিঙ্গাপুর কেবল আয়ু বাড়ায়নি, বরং জীবনযাপনকে আরও স্বাস্থ্যকর করেছে।
স্বাস্থ্যনীতির সাফল্য
সিঙ্গাপুরের অন্যতম বড় অর্জন হলো সুপরিকল্পিত স্বাস্থ্যনীতি। ফিন্যান্স ব্লগ ‘ডলার ব্যুরো’র লেখক ফিরদাউস সিয়াজওয়ানি বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে জনস্বাস্থ্যের পরিবর্তনটা আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি। ধূমপান ও মদ্যপানের ওপর উচ্চ কর আর প্রকাশ্যে ধূমপানের কড়া নিষেধাজ্ঞা শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের উন্নতি করেনি, পুরো পরিবেশকেই পরিষ্কার ও নিরাপদ করেছে।’
যদিও সিঙ্গাপুরের স্থানীয় খাবার বেশ তেল-ঝাল ও মিষ্টি, তবু সরকার ধীরে ধীরে মানুষকে স্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে আগ্রহী করে তুলেছে। দেশটির স্বাস্থ্য উন্নয়ন বোর্ড বাধ্যতামূলক পুষ্টি-লেবেল, পানীয়তে চিনি কমানো এবং সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছে। ফিরদাউস বলেন, ‘আগে আমি খুব সহজে ঠান্ডা ও মিষ্টি পানীয় কিনতাম। এখন বোতলে সতর্কীকরণ লেবেল দেখলে আর কিনতে ইচ্ছা করে না।’
এ ছাড়া সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্যসেবা বিশ্বে অন্যতম সেরা হিসেবে স্বীকৃত। লেগাটাম প্রোসপারিটি ইনডেক্স ২০২৩-এ স্বাস্থ্যসেবা ও সহজপ্রাপ্যতার দিক থেকে দেশটিকে প্রথম স্থানে রাখা হয়। দেশটিতে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা আছে।
সবুজ শহরের প্রাণ
দীর্ঘায়ুর জন্য শুধু স্বাস্থ্যসেবা নয়, পরিবেশও বড় ভূমিকা রাখে। সিঙ্গাপুর নগরায়ণকে এমনভাবে সাজিয়েছে, যাতে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যোগসূত্র অটুট থাকে। স্থপতি চারু কোকাতে বলেন, ‘সিঙ্গাপুর সত্যিই গার্ডেন সিটি। এখানে পার্ক, বাগান আর প্রকৃতি শহরের সঙ্গে একীভূত। ১৫ বছর ধরে এখানে আছি, এখনো অবাক হই, কীভাবে ছোট একটি দেশে এত সুন্দরভাবে টেকসই নগর-পরিকল্পনা করা হয়েছে।’ তাঁর প্রিয় স্থান সিঙ্গাপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনস, যা ইউনেসকো-ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। অর্কিডের বিশাল সংগ্রহ আর গবেষণার কাজ এটিকে করেছে অনন্য।
উচ্চ ব্যয়, উচ্চ মান
অবশ্য সিঙ্গাপুরে জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। মার্সার র্যাঙ্কিংয়ে এটি বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যয়বহুল শহর। তবে এখানকার মানুষ বিশ্বাস করে, কঠোর আইনশৃঙ্খলাই শহরকে নিরাপদ ও বসবাসের উপযোগী করেছে। আবর্জনা ফেলা, প্রকাশ্যে ধূমপান, মাদক এমনকি নিয়ম না মেনে রাস্তা পারাপার—সবকিছুর জন্যই রয়েছে কঠোর শাস্তি।
বহু সাংস্কৃতিক জীবনধারা
শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের পাশাপাশি সিঙ্গাপুর বহু সাংস্কৃতিক উৎসব ও খাবারের জন্যও বিখ্যাত। চীনা নববর্ষ, দীপাবলি, আন্তর্জাতিক শিল্প উৎসব—সবই দেশটিতে সমান উৎসাহে উদ্যাপিত হয়। সেখানকার খাবারের বৈচিত্র্যও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।
কোকাতে বলেন, ‘এখানে প্রত্যেকের জন্যই কিছু না কিছু আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সুযোগ আছে। বয়স যা-ই হোক বা যে সংস্কৃতি থেকেই আসুক না কেন, সিঙ্গাপুরের বহু সংস্কৃতির সমাজ মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন রীতি-উৎসব ও বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত করে। তাই এখানে মানুষের জীবন হয়ে উঠে প্রাণচঞ্চল।’
অন্য ব্লু জোনগুলোর মতো শতবর্ষী ঐতিহ্য নয়, বরং আধুনিক নীতি, উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা, সবুজ নগর-পরিকল্পনা ও সামাজিক বন্ধন—এসবের সমন্বয়ে সিঙ্গাপুর গড়ে তুলেছে দীর্ঘ ও মানসম্মত জীবনের এক নতুন মডেল।
সূত্র: বিবিসি
ক্রাইম জোন ২৪