‘পানি ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়ে আবার চলত নির্যাতন’


গাজীপুরের শ্রীপুরে গ্রেপ্তার শীর্ষ সন্ত্রাসী সুমন শেখের পাঁচটি টর্চার সেলের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। এসব টর্চার সেলে মানুষকে এনে বেঁধে শারীরিক নির্যাতনের পর আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের টাকা। রাতভর চলত মাদকের আড্ডা। ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে করা হতো নির্যাতন।
গত মঙ্গলবার রাতে উপজেলার বরমী ইউনিয়নের পাঠানটেক, বড়নল, কোষাদিয়া, বরকুল ও নান্দিয়া সাঙ্গুন গ্রামে সুমনের পাঁচটি টর্চার সেলের সন্ধান পায় পুলিশ। পর সেগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এ সময় সেগুলো থেকে একটি বন্দুক, দেশীয় অস্ত্রসহ লাঠিসোঁটা উদ্ধার করা হয়।
টর্চার সেলগুলোতে দেখা যায়, বরমী ইউনিয়নের পাঠানটেক গ্রামে একটি টিনশেডের ঘরে রয়েছে কাঠের ফার্নিচার, চেয়ার-টেবিল, বাঁশ, কাঠ। ইউনিয়নের বড়নল গ্রামের বাঁশতলা এলাকার টর্চার সেলে রয়েছে একটি চৌকি; এর চারপাশ রঙিন কাপড়ে ডেকে রাখা রয়েছে। বিছানো রয়েছে তোশক। চৌকির ওপরে কাঠের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে রশি। ঘরের ভেতর এক কোণে রয়েছে বাঁশের লাঠি ও লোহার পাইপ। একই গ্রামের অপর একটি টর্চার সেল। একটি টিনশেডের ঘরে রাতভর চলে মাদকের আড্ডা। ঘরের ভেতর শোকেস, ড্রেসিং টেবিল ও খাট রয়েছে। পড়ে ছিল বিভিন্ন রেস্তোরাঁর খাবারের প্যাকেট।
স্থানীয়দের বর্ণনায় উঠে আসে কাওরাইদ ইউনিয়নের নান্দিয়া সাঙ্গুন গ্রামে ত্রিমোহনী ব্রিজের নিচে কলাবাগানের টর্চার সেলে নিয়ে বহু মানুষকে নির্যাতনের ভয়ানক চিত্র। এ ছাড়া বরমী বাজারের কাঠমহলে কালো কাপড়ে ঢেকে নির্যাতন করা হতো তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া মানুষকে।
বরকুল গ্রামের সাহেব আলীর ছেলে সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক সুরুজ মিয়া বলেন, ‘২০২২ সালে সুমন বাহিনীর সদস্য রাসেল পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের পরপরই আমাকে দোষারোপ করতে থাকে বাহিনীর লোকজন। একপর্যায়ে সুমন বাহিনী আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায় পাঠানটেক গ্রামের চিতাশালের পেছনে তাদের টর্চার সেলে। সেখানে নিয়ে দুটি লোহার রডের সঙ্গে আমার হাত বাঁধা হয়। এরপর শুরু হয় নির্যাতন। আমি অচেতন হয়ে পড়লে গায়ে পানি ঢেলে জ্ঞান ফেরানোর পর আবার নির্যাতন চালানো হয়।
একপর্যায়ে গলায় ধারালো ছুরি ধরে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করে। পরে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। জীবন বাঁচাতে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে মুক্তি পাই। ওই টর্চার সেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর এক সপ্তাহেও উঠে দাঁড়াতে পারিনি।’
মোক্তার হোসেন নামের একজন বলেন, ‘২০২৪ সালে আমাকে মোটরসাইকেলযোগে বড়নল গ্রামের বাঁশতলা এলাকার টর্চার সেলে নেয় সুমন বাহিনী। হাত-পা বেঁধে চালানো হয় নির্যাতন। এরপর চাওয়া হয় মোটা অঙ্কের টাকা। দিতে অস্বীকৃতি জানালে নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় তারা। এরপর আমার স্ত্রী পুলিশের সহযোগিতা চেয়ে আমাকে উদ্ধার করে নেয়। পুলিশ আসার খবর পেয়ে সুমন বাহিনী পালিয়ে যায়। আজও সেই টর্চার সেল রয়েছে।’
আসাদুজ্জামান নামের একজন বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুমন বাহিনী আমাকে তুলে নেয় কলেজের পশ্চিম পাশের একটি ঘরে। সেখানে নিয়ে আমার হাত-পা রশি দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর আমাকে ইচ্ছেমতো পাড়ায়। আমার অপরাধ, একজনের টাকার জামিন হয়েছিলাম। পরে টাকা দিলে মুক্তি মেলে।’
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহম্মদ আব্দুল বারিক বলেন, গ্রেপ্তার সুমনের কয়েকটি টর্চার সেলের সন্ধান পেয়ে সেগুলোয় অভিযান চালানো হয়। টর্চার সেলগুলো থেকে একটি বন্দুক ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে শ্রীপুরে গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওপর হামলা চালিয়ে সুমনকে (৩২) ছিনিয়ে নেয় তাঁর সহযোগীরা। হামলায় পুলিশের তিন সদস্য আহত হন। পরে গত রোববার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে সুমনসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ক্রাইম জোন ২৪