ভারত কি ট্রাম্পের কাছে মাথা নত করবে, নাকি ঝুঁকি নেবে


মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের ফলে ভারত এক গুরুতর বাণিজ্য সংকটের মুখে পড়েছে। যদি আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনো চুক্তি না হয়, তাহলে ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্কের হার ৫০ শতাংশে উন্নীত হবে, যা ভারতের রপ্তানি খাতকে প্রায় অচল করে দিতে পারে। ভারত এখন আলোচনার জন্য ট্রাম্পের কাছে ভারত কি মাথা নত করবে, নাকি ঝুঁকি নেবে তাই দেখার বিষয়।
অবশ্য এই পরিস্থিতিতে ভারতের সামনে বেশ কিছু বিকল্প পথও খোলা আছে। সেগুলো হলো—
১. আরও আলোচনার চেষ্টা
ভারতের কর্মকর্তারা এখনো আশা করছেন, পর্দার আড়ালে আলোচনার মাধ্যমে কিছু মতপার্থক্য সমাধান করা সম্ভব। যদিও দুপক্ষই তাদের অবস্থানে অনড় রয়েছে। এই মাসের শেষের দিকে একটি মার্কিন প্রতিনিধিদলের ভারত সফরের কথা রয়েছে, যা একটি চুক্তির পথ খুলতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে আলোচনার জন্য কোন পক্ষ কার কাছে মাথানত করবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ বৃহস্পতিবার বলেছেন, দেশের কৃষক, দুগ্ধ ও মৎস্যজীবীদের স্বার্থে কোনো আপস করা হবে না, এমনকি এ জন্য ‘বড় মূল্য’ দিতে হলেও। অন্যদিকে, ভারতের কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, তারা বাদাম ও পনিরের মতো কিছু মার্কিন কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের ওপর শুল্ক কমানোর বিষয়ে আগ্রহী।
২. রুশ তেল আমদানি কমানো
ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ভারত রাশিয়া থেকে খুব সামান্য তেল কিনত। কিন্তু এখন তাদের মোট আমদানির এক-তৃতীয়াংশের বেশি আসে রাশিয়া থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে চাপ বাড়লে, ভারত তাদের পুরোনো সরবরাহকারী ইরাক, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তেল আমদানি বাড়াতে পারে।
কিন্তু ভারতীয় সূত্রগুলো বলছে, রাশিয়া থেকে তেল কেনার বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো পরিবর্তন আসবে না। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, ‘এগুলো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি। রাতারাতি বন্ধ করা এত সহজ নয়।’
গতকাল দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে ভারতের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে। মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, তাদের তেল আমদানি ‘বাজারের গতিবিধি’ এবং দেশের ১৪০ কোটি মানুষের ‘জ্বালানি নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার জন্য করা হয়। অন্যান্য অনেক দেশও যখন নিজেদের জাতীয় স্বার্থে একই ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, তখন ‘শুধু ভারতের ওপর’ যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
৩. ব্রিকস ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া
ব্রাজিলও ট্রাম্পের শুল্কের নতুন লক্ষ্যবস্তু। এই পরিস্থিতিতে ভারত ব্রিকস ব্লকের সদস্য দেশগুলো, যেমন—চীন, রাশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ট্রাম্পকে মোকাবিলা করতে পারে। ব্রিকসের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা আজ বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ফোন করে জোটের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছেন।
এ ছাড়া, ভারত রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফরের আগে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মস্কোয় গিয়েছেন। সীমান্তে সংঘাতের পর চীনের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক নতুন মোড় নিচ্ছে। ট্রাম্প যখন ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, ঠিক ওই সময়ই চীন সফরে যাচ্ছেন মোদি।
কিন্তু এত সম্ভাবনা থাকার পরেও যদি কোনো কারণে চুক্তি ব্যর্থ হয়, তাহলে ভারতের জন্য পরিণতি কী হবে? সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি আলোচনা ব্যর্থ হয় এবং ৫০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হয়, তাহলে ভারতের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে।
রপ্তানি খাত
গত অর্থবছরে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা ভারতের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। নতুন শুল্কের ফলে টেক্সটাইল, জুয়েলারি এবং পেট্রোকেমিক্যালসের মতো গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাতগুলো বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। ফার্মাসিউটিক্যালস ছাড়া অন্যান্য পণ্যের রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি
অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন যে, এই শুল্কের ফলে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ০.৬ থেকে ১ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এইচডিএফসি ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ সাক্ষী গুপ্তা সতর্ক করে বলেছেন, ‘যদি আগামী ২১ দিনের মধ্যে কোনো চুক্তি না হয়, তাহলে আমাদের ২০২৬ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। এতে জিডিপিতে ৪০-৫০ বেসিস পয়েন্টের ধাক্কা লাগবে, যা আমাদের আগের অনুমানের দ্বিগুণ।’
অন্যান্য খাত
শুধু বাণিজ্য নয়, ভিসা এবং আউটসোর্সিংয়ের মতো অন্যান্য ক্ষেত্রেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ট্রাম্পের এই ঘোষণার পরপরই গতকাল ভারতের শেয়ারবাজার প্রভাবিত হতে শুরু করেছে। ভারতের গিফট নিফটি ফিউচার শূন্য দশমিক ১ শতাংশ কমে ২৪,৫৫৫-তে দাঁড়িয়েছে, যেখানে আগের দিন বেঞ্চমার্ক নিফটি-ফিফটি ২৪,৫৭২-এ বন্ধ হয়েছিল।
এমতাবস্থায় বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ভারতের এই অচলাবস্থা কাটানোর জন্য ট্রাম্প ও মোদির মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ অপরিহার্য। কিন্তু দুজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যে যে ছেদ পড়েছে তা বন্ধ করে মোদি কি যোগাযোগ করবেন? ভারত কি ট্রম্পের কাছে মাথা নত করবে, নাকি ঝুঁকি নেবে?
তথ্যসূত্র: এনডিটিভি, রয়টার্স, আল-জাজিরা