৩ দিনে ১৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, নয়া রেকর্ডের পথে সৌদি আরব


সৌদি আরবে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে ১৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এ নিয়ে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেশটিতে মোট মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা দাঁড়াল ২৩৯-এ। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এই হার অব্যাহত থাকলে খুব দ্রুতই ২০২৪ সালের রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাবে দেশটি। ওই বছর দেশটিতে সর্বোচ্চ ৩৩৮ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল, যা ১৯৯০-এর দশক থেকে পাওয়া রেকর্ড অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি।
সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সৌদি প্রেস এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, গত রোববার ও শনিবার মোট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাঁদের মধ্যে ১৩ জন হাশিশ পাচার এবং একজন কোকেন পাচারের দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন। এরপর সোমবার আরও দুই সৌদি নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ‘সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধে’ জড়িত থাকার।
এই তিন দিনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের গতি ২০২২ সালের ১২ মার্চের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেদিন একদিনেই ৮১ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেই ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে রিয়াদ।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, সৌদি আরবে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তা গভীর উদ্বেগজনক। বিশেষ করে মাদক সংক্রান্ত মামলায় মৃত্যুদণ্ডের হার ক্রমেই বাড়ছে। বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ২৩৯টি মৃত্যুদণ্ডের মধ্যে ১৬১টিই ছিল মাদক সংক্রান্ত অপরাধে। এর মধ্যে ১৩৬ জনই ছিলেন বিদেশি নাগরিক।
মানবাধিকার সংগঠন রিপ্রিভের কর্মকর্তা জিড বাসিউনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী যখন হাশিশ ও অন্যান্য মাদকদ্রব্যের ব্যবহার অপরাধ হিসেবে গণ্য না করার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে, তখন সৌদি আরব ঠিক উল্টো পথে হাঁটছে। বিশেষ করে বিদেশি নাগরিকদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।’
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৩ সালে সৌদি সরকার যে ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধ’ শুরু করেছিল, এই মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা তারই ফলাফল। ওই সময় যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, এখন তাঁদের মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হয়ে আসছে এবং রায় অনুযায়ী একের পর এক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের পর কয়েক বছর মাদক সংক্রান্ত অপরাধে মৃত্যুদণ্ড স্থগিত ছিল সৌদি আরবে। কিন্তু ২০২২ সালের শেষ দিকে ফের তা কার্যকর শুরু হয়। তারপর থেকে ক্রমেই এই হার বাড়ছে।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে সৌদি আরব একাধিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি, কনসার্ট ও খেলাধুলার মতো বিনোদন খাতের উন্মুক্তকরণ, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ—সব মিলিয়ে দেশটি একটি উন্মুক্ত ও আধুনিক সমাজ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে ‘ভিশন ২০৩০’ কর্মসূচি চালাচ্ছে।
কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, একদিকে সংস্কারের বুলি আর অন্যদিকে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রবণতা—এই দুই বিপরীত বাস্তবতা সৌদি সরকারের ইমেজকে বিশ্বদৃষ্টিতে দ্বিধান্বিত করে তুলছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে, মৃত্যুদণ্ড কেবল তখনই কার্যকর করা হয়, যখন একজন আসামি সব ধরনের আইনি সুযোগ গ্রহণ করার পরও দোষী সাব্যস্ত হন। সরকারের মতে, এমন শাস্তি সমাজে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
তবে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সৌদি আরবের বর্তমান পরিস্থিতি প্রমাণ করে, ‘ভিশন ২০৩০ ’-এর মূল প্রতিশ্রুতি—একটি মানবিক ও সহনশীল রাষ্ট্র গঠনের দৃষ্টিভঙ্গি—ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তি সংস্কারের সঙ্গে মেলানো কঠিন।