নিরাপত্তা না দিয়ে চলে যায় পুলিশ


বরিশালে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক নেতা লিটন সিকদারের বাড়িতে হামলার পরপরই বিমানবন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। স্থানীয়রা তাঁকে বারবার লিটনকে নিরাপত্তার জন্য থানায় নিয়ে যেতে বললেও এসআই পুলিশ সদস্যদের নিয়ে ফিরে যান। এরপরই ঘটে নৃশংস হত্যার ঘটনা। ভুক্তভোগীর পরিবার ও স্থানীয়দের ভাষ্য এবং ভিডিও সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
এদিকে লিটন হত্যার ঘটনায় ৪০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন তাঁর বোন। এ ঘটনায় আটজনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
ভুক্তভোগী পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দরজা-জানালা ভেঙে ঘরের মধ্যে ঢুকে লিটনকে নৃশংসভাবে কোপানো হয়। তাঁর ডান হাত কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ঘরের আসবাবপত্র বাইরে এনে আগুন দেওয়া হয়েছে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এ তাণ্ডব চালানোর পর পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। ঘটনাস্থল থেকে বিমানবন্দর থানার দূরত্ব ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, পারিবারিক বিরোধের জেরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর বরিশাল নগরের উপকণ্ঠ কাশীপুর ইউনিয়নের বিল্ববাড়ি গ্রামে লিটন সিকদারকে (৩৮) হত্যা করা হয়েছে। প্রায় অর্ধশত লোক তাঁর বাড়িতে হামলা করেছে।
স্থানীয়রা জানান, লিটন ওই এলাকার নজির আলী সিকদারের ছেলে এবং রড-সিমেন্টের ব্যবসা করতেন। তাঁর বিরুদ্ধেও এলাকায় চাঁদাবাজি, ত্রাস সৃষ্টি করার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় আল আমিন নামের একজন জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজির অভিযোগে লিটনকে স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
লিটনের বাড়িতে হামলার সময়ের একটি ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, সড়কের পাশে তাঁর বাড়িতে হামলা চলছে। এসআই শহীদুল পুলিশ পিকআপে সামনের আসনে বসা। একজন লোক এসে তাঁকে বারবার অনুরোধ করছেন, তাঁকে (লিটন) গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান। না হলে কিছু একটা ঘটে যাবে। পুলিশের পিকআপ রওনা হলে ওই ব্যক্তি বারবার বলছেন, ‘আপনি এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত, এ অবস্থায় কোথায় যাচ্ছেন?’ গ্রেপ্তার করার অনুরোধ প্রসঙ্গে এসআই শহীদুল উল্টো বলেন, ‘তাঁর (লিটন) নামে কি মামলা হয়েছে?’
স্থানীয়দের তথ্যমতে, লিটনের বোন মুন্নীকে বিয়ে করেছেন একই গ্রামের জাকির গাজী। সম্প্রতি জাকির আরেকটি বিয়ে করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে লিটন ভগ্নিপতি জাকিরকে ২৩ জুলাই বাসার মধ্যে আটকে বেদম মারধর ও পুরুষাঙ্গে বিদ্যুতের শক দেন। মুন্নীর নামে ৩ শতাংশ জমির দলিলে জোর করে স্বাক্ষর করানো হয়। খবর পেয়ে আত্মীয়স্বজন জাকিরকে উদ্ধার করেন। ওই ঘটনায় লিটন, মুন্নীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন জাকিরের পরিবার। এর পর থেকে আসামিরা আত্মগোপনে ছিলেন। দুদিন আগে এলাকাবাসী লিটনের বিচার চেয়ে বিক্ষোভ করেন। বৃহস্পতিবার আদালত থেকে জামিন পেয়ে লিটন, মুন্নীসহ অন্যরা বাড়িতে যান।
খবর পেয়ে জাকিরের আত্মীয়স্বজনসহ গ্রামের লোকজন বাড়ি ঘেরাও করে হামলা করে। এসআই শহীদুলের নেতৃত্বে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে পুলিশ চলে যাওয়ার পরই লিটনকে হত্যা এবং তাঁর বোন মুন্নী, মা হালিমা বেগম ও ভাই সুমন সিকদারকে কুপিয়ে জখম করা হয়। তাঁরা গুরুতর আহত হয়ে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ঘটনাস্থল ত্যাগের কারণ জানতে চাইলে এসআই শহীদুল বলেন, তিনি পরিস্থিতি শান্ত করে ঘটনাস্থল ছাড়েন। এরপরে দ্বিতীয় দফার হামলায় লিটনকে হত্যা করা হয়। স্থানীয়দের অনুরোধের পরও কেন তাঁকে থানায় নিয়ে আসা হয়নি, জানতে চাইলে শহীদুল বলেন, ‘তাঁর নামে তো মামলা নেই। কেন তাঁকে আটক বা গ্রেপ্তার করব।’
শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, গ্রেপ্তারের ভয়ে গ্রামটি অনেকটা পুরুষশূন্য। দু-একজন পথচারীর দেখা পেলেও কেউ এসব বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। সড়কের পাশে লিটনদের বাড়ি। কয়েকজন পুলিশ সদস্য পাহারা দিচ্ছেন। বাড়িতে সদ্য নির্মিত একটি একতলা ভবন ও আরেকটি টিনের ঘর। সড়কের ওপর আগুন দেওয়া বিছানাপত্র আধা পোড়া অবস্থায় পড়ে আছে।
স্থানীয়রা জানান, লিটনদের আরেকটি বাড়ি আছে নগরীর বগুড়া সড়কে। ময়নাতদন্তের পর তাঁর মরদেহ সেখানে নেওয়া হয়। শুক্রবার আসরের নামাজের পর জানাজা শেষে বাসার অদূরে কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
বিমানবন্দর থানার ওসি জাকির সিকদার জানান, লিটন হত্যার ঘটনায় শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিহত লিটনও ৫টির বেশি মামলার আসামি।