সাপের বিষে তৈরি যে মদ পাওয়া যায় এশিয়ার বিভিন্ন দেশে


অনেকের কাছেই মদের বোতলে ডুবে থাকা সাপ, মোটেই রুচিকর বা মনোহর দৃশ্য নয়। তবে এশিয়ার কিছু অঞ্চলে এই ছবি আশার প্রতীক, স্বাস্থ্য ভালো রাখার প্রতিশ্রুতি। এই ব্যতিক্রমী পানীয়টির নাম ‘স্নেক ওয়াইন’ বা সাপের ওয়াইন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি পান করা হয়ে আসছে এই অঞ্চলে। অনেকেরই বিশ্বাস, এতে রয়েছে ওষধিগুণ।
স্নেক ওয়াইন বা সাপের ওয়াইনের উৎপত্তি বলে মনে করা হয় প্রাচীন চীনা চিকিৎসাব্যবস্থা, ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা ইউনানী চিকিৎসা শাস্ত্র থেকে। এই শাস্ত্রে বহুদিন ধরেই প্রাণিজ উপাদান ব্যবহার করে নানা রোগ নিরাময় ও স্বাস্থ্যোন্নয়ন করা হতো। সাপের নাম ওষধি উপাদান হিসেবে প্রথম পাওয়া যায় ‘দ্য ডিভাইন ফার্মারস ম্যাটেরিয়া মেডিকা’ নামে একটি গ্রন্থে। বইটি লেখা হয় হান রাজবংশের (২০২ খ্রিস্টপূর্ব–২২০ খ্রিস্টাব্দ) আমলে।
মিং রাজবংশের (১৩৬৮–১৬৪৪) বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন লি শিজেন। তিনি প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ উপাদান দিয়ে ওষুধ প্রস্তুত করতেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত বই ‘কমপেন্ডিয়াম অব ম্যাটেরিয়া মেডিকাতে’ সাপের ওষধিগুণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। প্রাচীন এ গ্রন্থ অনুযায়ী, সাপের বিষ শরীরকে উদ্দীপিত করে, রক্তসঞ্চালন উন্নত করে এবং অস্থিসন্ধির ব্যথা ও ত্বকের সমস্যার বিরুদ্ধে কার্যকর।
চীন ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও ভিয়েতনামের মতো অন্যান্য এশীয় দেশেও ‘স্নেক ওয়াইন’ পান করা হয়। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির সাপ থাকলেও, যেসব সাপের বিষ সবচেয়ে তীব্র, সেগুলো দিয়েই সবচেয়ে উন্নতমানের সাপের ওয়াইন তৈরি হয় বলে ধারণা করা হয়।
জাপানে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের ওকিনাওয়া দ্বীপে, সাপের এই ওয়াইনকে বলা হয় ‘হাবুশু’। নামটি এসেছে হাবু নামের একধরনের বিষধর সাপের নাম থেকে, যা ওই দ্বীপাঞ্চলে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। ওকিনাওয়ায় হাবুশু তৈরি হয় ‘আওমোরি’ নামে একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক মদে হাবু সাপ ডুবিয়ে রেখে।
স্নেক ওয়াইন তৈরির পদ্ধতি বেশ সূক্ষ্ম ও নিখুঁত। প্রথমে একটি বিষধর সাপ ধরা হয়। এরপর সতর্কতার সঙ্গে সেটিকে পরিষ্কার করা হয় এবং সেটির ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অপসারণ করা হয়, যাতে মদ দূষিত না হয়। পরে সাপটিকে একটি পরিষ্কার বোতল বা পাত্রে রাখা হয়। তারপর সেখানে উচ্চমাত্রার অ্যালকোহল—যেমন বাইজিউ, চাল থেকে তৈরি মদ বা অন্য কোনো শক্তিশালী স্পিরিট ঢেলে দেওয়া হয়, যেন সাপটি পুরোপুরি মদের মধ্যে ডুবে থাকে। তারপর বোতলটি সিল করে রাখা হয় এবং তা মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর ধরে মাটির নিচে বা অন্ধকার স্থানে রেখে ফারমেন্ট করানো হয়। এই সময়ের মধ্যে সাপের বিষ ধীরে ধীরে অ্যালকোহলের মধ্যে মিশে যায়।
সাপের ওয়াইনের রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। কোথাও একাধিক সাপ দিয়ে তৈরি করা হয়, কোথাও আবার নির্দিষ্ট ধরনের প্রাণী বা ভেষজ উপাদান যোগ করা হয়, নির্দিষ্ট শারীরিক উপকারের লক্ষ্যে। যদিও অনেকের বিশ্বাস, সাপের মদ এখনও স্বাস্থ্যকর, তবে এর কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। যদি প্রস্তুত প্রণালী যথাযথ না হয়, তবে এতে পরজীবী বা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। পাশাপাশি, সাপের বিষ যদি মাত্রাতিরিক্তভাবে শরীরে প্রবেশ করে, তবে তা প্রাণঘাতী হতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় বর্তমানে সাপের মদ তৈরি, বিক্রি ও পান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। চীনে যদিও এই পানীয় নিষিদ্ধ নয়, তবে যেসব সাপ সংরক্ষিত প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত, সেগুলো শিকার, হত্যা বা বেচাকেনা বেআইনি।
তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট