ভালো সুযোগ দেখছেন দেশের ব্যবসায়ীরা


যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশের সস্তা শ্রম, প্রতিযোগীদের তুলনায় কম শুল্কহার ও চীনের ওপর বাড়তি শুল্কের কারণে নতুন শুল্ক ব্যবস্থায় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবেন।
বিভিন্ন তথ্য বলছে, প্রতিযোগী ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের সম্ভাবনা বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের তুলা ব্যবহার বাড়ালে বাংলাদেশের বর্তমান শুল্কহার আরও কমানো সম্ভব। এতে রপ্তানি বাড়বে।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের (বিএই) তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক আমদানি করে ভিয়েতনাম, চীন ও বাংলাদেশ থেকে। এর মধ্যে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে উচ্চমূল্যের পোশাক আমদানি বেশি করে। গত বছরের শেষ দিকেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীন প্রথম স্থানে ছিল। কিন্তু বেইজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ ও বাড়তি শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি ক্রমাগত কমছে। সর্বশেষ জানুয়ারি থেকে মে—এই পাঁচ মাসে ১০ শতাংশের বেশি রপ্তানি কমেছে চীনের। ফলে প্রথম স্থান চলে গেছে ভিয়েতনামের দখলে। তবে ভিয়েতনামের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও বাংলাদেশের তুলনায় কম। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ভিয়েতনামের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ শতাংশ, এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ রপ্তানিকারক ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির কাছাকাছি রয়েছে পাকিস্তান, ২১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান ৯ নম্বরে।
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, বাংলাদেশ কয়েকটি কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে এবং থাকবে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো সহজলভ্য শ্রম, যা ভিয়েতনাম ও চীনের নেই। এ ছাড়া ট্যারিফ হারও প্রতিযোগীদের তুলনায় কম। যেমন চীনের পণ্যের জন্য পাল্টা শুল্ক ৩০ শতাংশ, ভারতের পণ্যে ২৫ শতাংশ। ভিয়েতনামের বাংলাদেশের সমান ২০ শতাংশ। তবে যুক্তরাষ্ট্র তুলার ক্ষেত্রে যে সুবিধা দিয়েছে, তা হিসাব করলে ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। সে হিসেবে চীন থেকে সরে যাওয়া ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই বাংলাদেশে আসবে।
বিএইর তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মোট ৩১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে ভিয়েতনামের রপ্তানি ৬ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা গত বছর একই সময় ছিল ৫ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। গত বছর রপ্তানির দিক থেকে ভিয়েতনাম ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি ৪ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার, গত বছর একই সময়ে ছিল ৫ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৩ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। গত বছর একই সময় ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিতে পঞ্চম ইন্দোনেশিয়ার ওপর পাল্টা শুল্ক ১৯ শতাংশ হলেও রপ্তানি এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির ব্যবধান অনেক। প্রথম পাঁচ মাসে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এখন চতুর্থ। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে দেশটির রপ্তানি ২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলারের। ভারতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘আমাদের প্রতিযোগিতা এখন একমাত্র ভিয়েতনামের সঙ্গে। ভারত সহসা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবে না। কারণ তারা এখনো রপ্তানিতে অনেক পিছিয়ে, ভারতের ওপর পাল্টা শুল্ক বাংলাদেশের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি।’
বাংলাদেশের শুল্কহার আরও কমানো সম্ভব বলে মনে করেন তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ীরা। তাঁরা জানান, এতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় আরও এগিয়ে যাবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় ৭৫ শতাংশ হচ্ছে তুলাভিত্তিক পোশাক। ওই দেশের শুল্ক-সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশে (ক্লজ নম্বর এফ; পৃষ্ঠা ১৩ ও ১৪) বলা আছে, যেকোনো পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করলে তার উপকরণে যদি ২০ শতাংশ বা এর বেশি সে দেশটির কাঁচামাল থাকে তাহলে রপ্তানি পণ্যের সেই অংশে পাল্টা শুল্কহার প্রযোজ্য হবে না বা শূন্য থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা পোশাকে ৫০ শতাংশ মার্কিন কটন থাকলে ওই ৫০ শতাংশের ওপর নতুন ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপিত হবে না। অর্থাৎ মার্কিন কাঁচামাল ব্যবহার করলে বাড়তি কিছু শুল্কছাড় পাবে বাংলাদেশ।
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী একাধিক দেশ নিজেদের উৎপাদিত সুতা (কটন) ব্যবহার করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য কম আমদানি করে। ফলে তাদের পক্ষে হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা এটি পারব। বর্তমানে বাংলাদেশ ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সুতা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে। এটিকে ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার করা খুবই সম্ভব। এতে প্রতিযোগিতায় আমরা এগিয়ে যাব।’
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী কম্বোডিয়ার অবস্থান ৮ ও পাকিস্তানের স্থান ৯ নম্বরে। এ দুটি দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ১৯ শতাংশ। কম্বোডিয়া বছরের প্রথম পাঁচ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ১ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। একই সময়ে পাকিস্তান রপ্তানি করেছে ১ বিলিয়ন ডলারের কম ৯৫১ মিলিয়ন ডলার। রপ্তানিতে প্রতিদ্বন্দ্বী অপর দুই দেশের মধ্যে মেক্সিকোর রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ২.৮ শতাংশ এবং হন্ডুরাসের রপ্তানি কমেছে ১২ শতাংশ।