গ্রাহকের কাছ থেকে ৮৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত আদায়


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে নিয়মবহির্ভূতভাবে বাড়তি দামে ডলার বিক্রি করেছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। ডলার কারসাজির মাধ্যমে ব্যাংকটির ঢাকা প্রধান কার্যালয়, উত্তরাসহ কয়েকটি শাখায় গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ৮৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত আদায় করা হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। অভিযোগের সত্যতা মেলায় এরই মধ্যে ব্যাংকটির এক ডিএমডিসহ দুই কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা যায়, মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ২০২২ সালের ডলার-সংকট তীব্র আকার ধারণ করলে সেই সুযোগ লুফে নিতে ডলার কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। অতিরিক্ত দরে ডলার লেনদেনের দায়ে ২০২৩ সালে ব্যাংকটিকে জরিমানাও করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
নথিপত্র অনুযায়ী, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ডলার কারসাজির নেপথ্যে ছিলেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ উদ্দিন ও ঢাকা প্রধান কার্যালয়ের তৎকালীন ম্যানেজার (ডিএমডি) মোস্তফা হোসেন। মোসলেহ উদ্দিন ২০২২ সালে এনসিসি ব্যাংক থেকে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে যোগ দিয়েই ঢাকা ব্যাংক থেকে মোস্তফা হোসেনকে নিয়ে আসেন এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ঢাকা প্রধান কার্যালয়ের দায়িত্ব দেন। এই দুজনের যোগসাজশে ডলারের বাড়তি দাম নিত ব্যাংকটির ঢাকা প্রধান কার্যালয়। গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া বাড়তি টাকা তাঁরা ব্যাংকের হিসাবে জমা না করে ব্যক্তিগত হিসাবে লেনদেন করতেন, যা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির নিজস্ব নিরীক্ষায় ধরা পড়ে। এমনকি অডিট টিম ঢাকা প্রধান কার্যালয়ের এভিপি ও ইমপোর্ট ইনচার্জ মোহাম্মদ নকিবুল হকের ড্রয়ার থেকে ক্যাশ চেক ও পে-অর্ডার হাতেনাতে উদ্ধার করে, যার পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ কোটি টাকা। তদন্ত টিম ২৮ লাখ টাকার আত্মসাতের প্রমাণও পায়। সর্বোপরি প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ডিএমডি মোস্তফা হোসেনকে চাকরি থেকে বরখাস্ত এবং এভিপি নকিবুল হককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
তথ্য বলছে, শাহজালালের ঢাকা প্রধান কার্যালয়ে ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৮ মে পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূতভাবে গ্রাহকের কাছ থেকে অতিরিক্ত এক্সচেঞ্জ গেইন বাবদ আদায় করা হয়েছে ৮৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে গাজী ইন্টারন্যাশনাল, গাজী ট্যাংক, গ্লোবাল ব্র্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ক্যাশের মাধ্যমে ৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা নেওয়া হয়। পাশাপাশি ইনগ্লোন ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেডের কাছ থেকে ৮ লাখ ৪৮ হাজার নেওয়া হয় স্পনসরশিপের আড়ালে। যদিও ব্যাংকটির অডিটে গাজী ট্যাংকের কাছ থেকে ৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকার ৮টি চেক উদ্ধারের কথা জানানো হয়েছে, যা ব্যাংকে নির্ধারিত হিসাবে জমা হয়নি।
এ বিষয়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ উদ্দিন আজকের পত্রিকা‘কে বলেন, ‘ডলার থেকে এক্সচেঞ্জ গেইন ব্যাংকের একটি বিশ্বব্যাপী নিয়ম। ব্যাংক তো গ্রাহকের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ঘোষণা দিয়ে ডলার কেনাবেচা করে। সেখানে তো রেট ভিন্ন না হলে ব্যবসা থাকবে না। কোনো আইনে গ্রাহকের কাছে বেশি দরে ডলার বিক্রয় করা অবৈধ নয়। আমরা আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নীতিমালা অনুযায়ী ডলার লেনদেন করেছি। এতে কোনো অনিয়ম করা হয়নি।’
ডলার-সংকট চলাকালে শুধু শাহজালাল নয়, অন্তত ২০টি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘোষিত ডলার রেটের বেশি দামে ডলার লেনদেন করেছে বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত রেট জানার পরে তার চেয়ে কমপক্ষে ১ টাকা বেশি দরে ডলার ছাড়ে। যেহেতু আমদানি বেশি রপ্তানি কম, সে জন্য গ্রাহকের স্বার্থে বাধ্য হয়ে বেশি দামে ডলার কিনে আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকে ঘোষিত দর দেখানো হয়। আর বাড়তি রেট ভাউচার ও চেকের মাধ্যমে সমন্বয় করা হয়। এটা বাংলাদেশ ব্যাংক জানত। এমনকি ফোনে বেশি দরে কেনারও পরামর্শ দিতেন তখনকার কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ডলার বাড়তি দরে বিক্রয় করতে পারে। এটা মুক্তবাজারের অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি। কিন্তু তারা ডলারের লেনদেনের দর এবং পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকে জানাতে বাধ্য। আর ডলার লেনদেনে যে এক্সচেঞ্জ গেইন হয়, তা তো ব্যাংকের হিসাবে জমা করতে হবে। যেহেতু এ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে, সে জন্য চূড়ান্ত প্রতিবেদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ডলার লেনদেনে দামের পার্থক্য থাকবে। সেটাই তো ব্যাংকের ব্যবসা। তবে অস্বাভাবিক দরে লেনদেন করলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকে জানাতে বাধ্য যেকোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক। শাহজালাল ব্যাংকের নিয়মের বাইরে থাকার সুযোগ নেই। তবে ২০২২ সালে ডলার-সংকট দেখা দিলে রেট নিয়ে অনেক ব্যাংক বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে। অন্তত ১০টি ব্যাংককে জরিমানা করা হয়েছিল।
ক্রাইম জোন ২৪