ট্রাভেল এজেন্সির ফজলু ও মিজানের দিকেই সন্দেহের তীর


রাজধানীর মৌচাকে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের পার্কিংয়ে একটি প্রাইভেটকার থেকে দুজনের লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ করছে নিহতদের স্বজনেরা। মরদেহের শরীরে রক্ত ও মুখ ফোলা দেখেই এই সন্দেহ তাঁদের।
গত সোমবার দুপুরে ওই প্রাইভেট কার থেকে জাকির হোসেন (২৮) ও মিজানুর রহমান (৪৪) নামে দুই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে রমনা থানা-পুলিশ। তাঁদের হত্যা করা হয়েছে নাকি অন্য কোনো কারণে মৃত্যু হয়েছে—এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কিছু জানাতে পারেনি পুলিশ।
গতকাল মঙ্গলবার নিহত দুজনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার লটপটিয়া গ্রামে জাকির হোসেনকে এবং একই উপজেলার দক্ষিণ গোমাতলী গ্রামে মিজানুর রহমানকে দাফন করা হয়।
আজ বুধবার রাতে নিহত জাকির হোসেনের বাবা মো. আবু তাহের আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শরীর রক্তমাখা ছিল, মুখ ফোলা ছিল। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে শরীরে রক্ত থাকবে কেন। গাড়িতেও নাকি রক্ত পড়ে ছিল। গাড়ির মধ্যেও লাশ উল্টো হয়ে পড়ে ছিল। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে এসবতো হতো না।’
আবু তাহের আরও বলেন, ‘বিদেশে যাওয়ার টাকা যেই ট্র্যাভেল এজেন্সিকে দিয়েছিলাম, সেই টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে আমার ছেলেকে একবার মারধরও করেছিল। ঘটনার দিনও আমার ছেলেকে ১০ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। তাই সন্দেহ হয় এটা হত্যাকাণ্ড।’
জাকিরের মামাতো ভাই সাব্বির ইসলাম বুধবার (১৩ আগস্ট) রাতে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ট্রাভেল এজেন্সির ফজলু ও মিজান নামের যেই দুই ব্যক্তিকে বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকা দেওয়া হয়েছিল, তাদের অফিস ঢাকার পল্টনে। তবে সেই অফিসে তাদের এজেন্সির কোনো নাম বা লোগো ছিল না। তাদের সঙ্গে জাকিরের ফোনে যোগাযোগ হতো। তদন্তের জন্য জাকিরের ফোনটি পুলিশের কাছে আছে। তাই ফজলু ও মিজানের কোনো নাম্বার আপাতত আমাদের কাছে নেই।’
নিহত মিজানুরের ভাগিনা মো. রিয়াদ মঙ্গলবার বলেছিলেন, ‘জাকির আর মিজানুর দুজন বন্ধু। জাকির প্রায়ই মিজানুরকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন গাড়ি চালানো শেখাতে। শনিবার রাতে তারা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে গাড়ি ভাড়া নিয়ে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। এরপর কী হয়েছে আমরা জানি না। তবে তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে এটা বুঝতে পারছি।’
এদিকে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনেও মরদেহের বিভিন্ন চিহ্ন উল্লেখ করা হয়েছে। মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনে রমনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আওলাদ হোসেন উল্লেখ করেন, জাকিরের শরীরে মাথা রক্তমাখা ও ফোলা, কপাল ফোলা ও পচন ধরেছিল। দুই চোখ বন্ধ, ফোলা, রক্তমাখা, ফোসকা পড়া। দুই কানও রক্তমাখা, ফোসকা পড়া এবং রক্ত নির্গমন পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া রক্তমাখা খোলা মুখ খোলা এবং দাঁত দৃশ্যমান ছিল। সমগ্র মুখমন্ডল ফোলা, রক্তাক্ত।’
মিজানুরের লাশের ব্যাপারে আওলাদ হোসেন বলেন, ‘শরীর ও মাথা রক্তমাখা, ফোলা। কপাল রক্তমাখা ও ফোলা। দুই চোখ বন্ধ, ফোলা, রক্তমাখা, ফোসকা পড়া। দুই কানও রক্তমাখা, ফোসকা পড়া এবং রক্ত নির্গমন পরিলক্ষিত হয়। মুখ খোলা, জিহ্বা দৃশ্যমান। সমগ্র মুখমণ্ডল ফোলা, রক্তাক্ত।’
এ ঘটনায় গাড়িচালক জাকিরের বাবা আবু তাহের বাদী হয়ে রমনা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছেন। রমনা-থানা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করছে। মামলার তদন্ত করতে ঘটনাস্থল থেকে তিনটি সিসি (ক্লোজ সার্কিট) ক্যামেরার প্রায় ৩২ ঘণ্টার ফুটেজ সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করেছে পুলিশ। ফুটেজে এই সময়ের মধ্যে পার্কিংয়ে থাকা ওই গাড়ির কাছে বাইরে থেকে কাউকে যেতে দেখা যায়নি। আবার গাড়ি থেকেও কাউকে বের হতে দেখা যায়নি বলে জানান মামলার তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হাসপাতালের সামনের অংশে থাকা একটি এবং পার্কিংয়ে থাকা দুটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ফুটেজে দেখা যায়, রোববার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে গাড়িটি পার্কিংয়ে প্রবেশ করে। তারপর আর বের হয়নি। এই সময়ের মধ্যে ওই গাড়ির কাছে বাইরে থেকে কাউকে যেতেও দেখা যায়নি। পরে লাশ উদ্ধারের সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায় অনেক সময় ধরে চালু থাকার কারণে গাড়ির গ্যাস শেষ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ব্যাটারির চার্জও শেষ হয়ে গিয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, গাড়িটি থেকে প্রচুর পরিমাণ গ্যাস বের হয়ে কার্বন মনোঅক্সাইড তৈরি হয়। আবার দীর্ঘ সময় এসি চালু থাকায় সেখান থেকেও অতিমাত্রায় কার্বন মনোঅক্সাইড গ্যাস বের হয়ে থাকতে পারে। এই গ্যাস শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে তাঁদের শরীরে প্রবেশ করে তাঁদের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। আর দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ির মধ্যে বদ্ধ অবস্থায় থাকার কারণে গরমে এক দিনেই তাদের শরীর অস্বাভাবিক ফুলে যায়। তবে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ও ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছেন। সবকিছু মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন আজকের পত্রিকাকে বলেন, এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় হত্যা বা অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, গাড়ির গ্যাস বের হয়ে সেটি বিষাক্ত কার্বন মনোঅক্সাইড তৈরি হয়ে মৃত্যু হতে পারে। তবে ময়নাতদন্তের ও ভিসেরা (ফরেনসিক) রিপোর্টের পর আমরা মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে পারব।
ক্রাইম জোন ২৪