মিয়ানমারের রাখাইনে জান্তা সরকারকে নির্বাচন করতে দেবে না আরাকান আর্মি


মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির জান্তা সরকারকে কোনো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে দেবে না স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশ সংলগ্ন এই রাজ্যটিতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে চলতি বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের কোনো স্বীকৃতি তারা দেবে না।
গতকাল সোমবার থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এএ—এর মুখপাত্র খাইং থুকহা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘আমরা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় কোনো নির্বাচন হতে দেব না। মিয়ানমার সরকারের পরিচালিত কোনো নির্বাচন কখনোই রাখাইন জনগণের কল্যাণে হয়নি।’
এর আগে, ২০২৩ সালের নভেম্বর পশ্চিম মিয়ানমারে ‘অপারেশন-১০২৭’ নামে যুদ্ধে নেমে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১৪টি এবং পাশের চিন রাজ্যের পালেতওয়া টাউনশিপকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। বর্তমানে তারা রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়েকে ঘিরে রেখেছে এবং কায়াকফিউ দ্বীপ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য তীব্র লড়াই চালাচ্ছে। এই দ্বীপে চীনের বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রকল্পগুলি অবস্থিত।
খাইং থুকহা আরও বলেন, ‘নির্বাচন মানুষের সেবা করার জন্য হয়। যদি তা না হয়, তবে তা কেবল জনগণকে বিভ্রান্ত করবে।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, জান্তার এই নির্বাচন কেবলই ধোঁকা এবং স্থানীয় জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা।
দীর্ঘ চার বছর ধরে ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমারের সামরিক শাসক গোষ্ঠী সম্প্রতি নিজেদের শাসন সংস্থা স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলের (এসএসি) নাম পরিবর্তন করে স্টেট সিকিউরিটি অ্যান্ড পিস কমিশন বা এসএসপিসি রেখেছে। গত ৩১ জুলাই রাজধানী নেপিদোতে অনুষ্ঠিত সামরিক নেতৃত্বাধীন জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের সভায় এ পরিবর্তন ঘোষণা করা হয়।
এর পরপরই দেশের ৬৩টি টাউনশিপজুড়ে জরুরি আইন জারি করা হয়। তবে এএ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, জরুরি আইন তাদের অভিযান বা লক্ষ্যে—রাখাইন রাজ্যের সব টাউনশিপ দখলের পরিকল্পনায়—কোনো প্রভাব ফেলবে না।
এএ মুখপাত্র জানান, বর্তমানে কায়াকফিউ টাউনশিপের ৩২-পুলিশ ব্যাটালিয়ন নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য তীব্র লড়াই চলছে। পাশাপাশি, জান্তাবাহিনী সিতওয়ে, পায়াকতাও এবং পোন্নাগিউন টাউনশিপে ব্যাপক গোলন্দাজ হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব বোমাবর্ষণ ও গোলাবারুদ ব্যবহারে রাখাইন রাজ্যে ১১ হাজারের বেশি বাড়িঘর, স্কুল ও হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে।
গবেষক এবং স্থানীয় নেতারা বলছেন, এই সশস্ত্র সংঘাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে রাখাইন রাজ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত (আইডিপি) হয়েছে। বাস্তুচ্যুত এসব মানুষের জীবনযাত্রা একেবারেই দুরবস্থায় পড়েছে।
এই অবস্থায়, আরাকান আর্মি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে ত্বরিতগতিতে রাখাইনের বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে, ‘বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই সংকটময় পরিস্থিতিতে রাখাইন জনগণের পাশে দাঁড়ানো।’
রাখাইনে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দীর্ঘদিনের। আরাকান আর্মি এখন সেই সংগ্রামে প্রধান শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। তারা রাখাইন জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এবং নিজেদের এলাকায় মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনীর নির্বাচনী প্রচেষ্টাকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এই নির্বাচনের মাধ্যমে সামরিক শাসকেরা দেশটিতে পুনরায় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করলেও, রাখাইনসহ নানা অঞ্চল থেকে এর তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক মহলও এই নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। পরিস্থিতি দিন দিন তীব্র হতে থাকায় রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে ভবিষ্যতে আরও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে।
ক্রাইম জোন ২৪