২৫ লাখ টাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলে জাকিরকে শ্রীলংকায় নিয়েছিল দালাল


রাজধানীর মৌচাক ডাক্তার সিরাজুল ইসলাম মেডিকেলের পার্কিংয়ে জাকির ও মিজানুরকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ স্বজনদের। তাঁরা জানান, জাকিরকের যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর কথা বলে ২৫ লাখ টাকা নিয়েছিল এক দালাল। কিন্তু তাঁকে শ্রীলংকা নিয়ে অবৈধ পথে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল। পরিবার আরও টাকাপয়সা দিয়ে তাঁকে ফেরত আনতে সক্ষম হয়। জাকির সেই টাকা আর তুলতে পারেননি। গত ১০ আগস্ট টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরদিনই তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিহতের স্বজনেরা এসব কথা বলেন। নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার লটপটিয়া গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে জাকির হোসেন। আর দক্ষিণ গোমাতলী গ্রামের মৃত আব্দুল হাকিমের ছেলে মিজানুর। তাঁরা বন্ধু ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্বজনেরা।
নিহত মিজানুরের ভাগিনা মো. রিয়াদ বলেন, ‘আমার মামা আগে গ্রামে বালুর ব্যবসা করতেন। সেই ব্যবসা বাদ দিয়ে আপাতত মাছের খামার করছিলেন। তিনি কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। জাকির আর মিজানুর দুই বন্ধু। জাকির প্রাইভেটকার চালাতেন, আর প্রায়ই মিজানুরকে সাথে নিয়ে যেতেন, তাঁকেও গাড়ি চালানো শেখাতেন। শনিবার রাতেই তাঁরা দুজন, গাড়ির মালিক ও মালিকের স্ত্রীর বড় ভাই (সম্বন্ধী) গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। মালিকের সম্বন্ধীর ওইদিন রাতেই বিদেশের ফ্লাইট ছিল। বিমানবন্দর থেকে ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেলে আসেন জাকির ও মিজান। একজন রোগী নিয়ে পরদিন গ্রামে ফেরার কথা ছিল। এরপর কী হয়েছে আমরা জানি না। তবে তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে এটা বুঝতে পারছি।’
জাকিরের বাবা মো. আবু তাহের বলেন, ‘আমার ছেলের কারও সাথে কোনো ঝগড়াঝাঁটি নাই। কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত না। কারা তাকে মেরেছে তাও জানি না। তবে, দুই বছর আগে আগে আমেরিকা যাওয়ার জন্য এলাকার এক দালালকে টাকা দিয়েছিলাম। সেই দালাল তাদের নিয়ে এসেছিল ঢাকায় পল্টনে এক ট্র্যাভেল এজেন্সির ফজলু নামে এক ব্যক্তির কাছে। সব মিলিয়ে তখন প্রায় ২৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। এরপর জাকিরকে শ্রীলঙ্কা নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে অবৈধ পথে আমেরিকা পাঠানোর কথা ছিল। তবে পারেনি। এরপর আরও কিছু টাকা দিয়ে তাকে আমরাই দেশে ফেরত আনি।’
আবু তালেব আরও বলেন, ‘এরপর থেকে ফজলুর কাছে সেই টাকা ফেরত চাইতে গেলে সে কিছুদিন পর টাকা ফেরত দেবে বলে জানায়। এরপর বহুবার তার পেছনে ঘুরেও টাকা ফেরত পাচ্ছিলাম না। এই টাকা চাওয়ার কারণে তারা আমার ছেলেকে একবার মারধরও করেছিল। সবশেষ কিছুদিন আগে এলাকাতে দালালের সাথে কথা হয় এবং স্ট্যাম্পে সই করে যে, চলতি মাসের ১০ তারিখে সেই টাকা ঢাকায় এজেন্সিতে এসে ফেরত দেবে। কিন্তু ওই ১০ তারিখেই জাকিরকে মেরে ফেলা হয়েছে। এই ঘটনা তারাই ঘটিয়েছে বলে আমাদের ধারণা। তারা ছাড়া আর কেউ এটি করতে পারে না।’
প্রাইভেটকারের মালিক জোবায়েদ আল মাহমুদ সৌরভ জানান, নিহত দুই জন ও তাঁর বাড়ি একই উপজেলায়। ১১ বছর ধরে গাড়ির ব্যবসা করেন তিনি। তিন মাস ধরে তাঁর প্রাইভেটকার ভাড়ায় চালান জাকির হোসেন। গত শনিবার তাঁর সম্বন্ধীর ইতালির ফ্লাইট ছিল। এ কারণে তাঁরা চার জন গাড়িতে করে ঢাকায় আসেন। সম্বন্ধীকে বিমানবন্দরে নামিয়ে তিন জন মৌচাক ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেলে যান। সেখানে তাঁদের গ্রামের এক রোগী ভর্তি ছিলেন। তাঁকে রোববার সকাল ১১টায় ছাড়পত্র দেওয়ার কথা ছিল। শনিবার ভোরে হাসপাতালে পৌঁছানোর পর মালিক সৌরভ সিদ্ধান্ত নেন, বাসে করে যাবেন। আর জাকির ও মিজানুর সকালে রোগীসহ গ্রামে ফিরবেন। সেই কথামতো তিনি বাসে করে চলে আসেন। বাসের টিকিট কেটে দেন জাকির। রোববার বিকেলে জাকিরকে ফোনকল করেন। কিন্তু ওপার থেকে কেউ রিসিভ করছিল না। এরপর অনেকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। পরদিন অর্থাৎ সোমবারও যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। সোমবার বিকেলে তিনি ঢাকায় আসার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এর আগে সোমবার বেলা ৩টার দিকে রমনা থানা-পুলিশ তাঁকে ফোনকল করে জানায়, হাসপাতালের পার্কিংয়ে তাঁর গাড়ির ভেতর থেকে দুই জনের লাশ পাওয়া গেছে।
এর আগে, মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে রমনা থানা-পুলিশ। প্রতিবেদনে উপপরিদর্শক (এসআই) আওলাদ হোসেন উল্লেখ করেন, তাঁদের শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ফোলা ও ফোসকা পড়া। এ ছাড়া মুখ লালচে, ফোলা ও রক্তমাখা। প্রাথমিকভাবে তাঁদের মৃত্যুর কোনো কারণ উল্লেখ নেই প্রতিবেদনে।
ক্রাইম জোন ২৪