এই বর্ষায় ফটিকছড়ির ঝিরিপথে


বর্ষা মানেই সজীব প্রকৃতি আর পাহাড়ের গায়ে মেঘমালার খেলা। ঝিরি, ঝরনার প্রাণ ঝুম বৃষ্টি। গাছগাছালিও বৃষ্টির কারণে গাঢ় সবুজ হয়ে ওঠে। এ ছাড়া পাহাড়ি খালগুলো হয়ে ওঠে খরস্রোতা। এমন দিনেই অ্যাডভেঞ্চারের মজা পাওয়া যায় পরিপূর্ণ। আর অ্যাডভেঞ্চার মানেই বর্ষার পাহাড়, ঝরনা, ঝিরিপথে ট্রেকিং।
সেই রোমাঞ্চের খোঁজেই এক রাতে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িগামী বাসে উঠে পড়ি। ভোরে বিবির হাটে নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চেপে চলে যাই হাজারীখিল লালার হাট বাজার। সেখানে ছিলেন আমাদের পূর্বপরিচিত আশিস। তিনি আগেই প্রয়োজনীয় কাজ সেরে রেখেছেন। তাই সময় নষ্ট না করে গাইড নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। শুরুটা রাঙাপানি চা-বাগান দিয়ে।
সবুজ কচি চা-পাতার ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে আমরা এগোতে থাকি। চা-বাগান পেছনে ফেলতেই দেখা মেলে ঝিরিপথের। আমাদের গন্তব্য কালাপানি ঝরনা। ছোট-বড় পাথর মাড়িয়ে ছুটে চলছি। দৈত্যাকৃতির গাছ, লাতা আর গুল্মে ঠাসা চারপাশ। এমনই নৈসর্গিক পরিবেশে নিজেদের ধীরে ধীরে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
পূর্ব অভিজ্ঞতা বলছে, কালাপানি ট্রেইল অন্যান্য ট্রেইল থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম হবে। হয়েছেও তাই। ঝিরির পানির নিচে ঘন ঘন গভীর খাদ। একটু বেখেয়াল হলেই কুপোকাত। যতই আমরা এগোচ্ছি, রোমাঞ্চকর ট্রেইল যেন ততই মেলে ধরছে নিজেকে। কখনো টিলা পার হয়ে, কখনো পড়ে যাওয়া বড় বড় গাছের নিচ দিয়ে, কখনোবা লতা-গুল্মের সাহায্যে ঝুলে সামনে যেতে হচ্ছে।
ঘণ্টাখানেক হাইকিং করার পর হলো আমাদের নুডলস বিরতি! কেউ পাথর কুড়িয়ে চুলা বানাতে ব্যস্ত, কেউবা জঙ্গল থেকে জোগাড় করে আনল লাকড়ি। আগুন ধরিয়ে ঝিরির পানি দিয়েই রান্না করা হলো মজাদার নুডলস। রান্না যেমনই হোক, এই বুনো পরিবেশে সব খাবারই সুস্বাদু হয়।
কোথাও কেউ নেই, আমরা ছাড়া! খেয়েদেয়ে আবারও হাইকিং। নামটা কালাপানি হলেও পানি কিন্তু সাদা! পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এমনটা হয়েছে আসলে। জোঁকের কোনো যন্ত্রণা নেই! এটি চিন্তার বিষয়। যেতে যেতে বেশ ঘেমে উঠলাম আমরা। জঙ্গল হলেও বাতাস নেই, ভ্যাপসা গরম। ক্লান্তি দূর করতে সবাই খুমে নেমে পড়লাম। পানি তীব্র ঠান্ডা। নিমেষে আমাদের ক্লান্তি উবে গেল। ইচ্ছেমতো হলো জলকেলি। দেহ-মনে প্রশান্তি ভর করতেই সঙ্গে নেওয়া পাহাড়ি পাকা আমের ওপর হামলে পড়লাম সবাই।
এ পাশটায় ট্রেইল আরও বুনো। যেতে যেতে কানে ভেসে আসে বন্য পরিবেশের অচেনা শব্দ।

দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সরু ফাঁক গলে আমাদের এগোতে হচ্ছে। কোনো কোনো জায়গা বুকসমান পানি। অল্প কিছু জায়গা পার হতে হলো সাঁতরে। পানির কলকল আওয়াজ বাড়লে আমাদের মনে রোমাঞ্চও বাড়ে। প্রাগৈতিহাসিক কোনো জায়গার মতো একটা জায়গা পার হলে চোখে ধরা দেয় তীব্র গতিতে ছুটে চলা পানির ধারা। বড় বড় পাথরের ফাঁক গলে গড়িয়ে যাওয়া পানির তীব্রতা দেখতে কী যে দারুণ। পানির গড়ানো শব্দ মনে চমৎকার অনুভূতি সঞ্চার করে।
পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে বোঝা যাচ্ছে, ঝরনা আর বেশি দূরে নয়। ম্যাঙ্গো বার ও পিনাট বার মুখে পুরে বেশ সতর্কতার সঙ্গে এগোতে থাকি। ঝিরির পাথরগুলো বেশ পিচ্ছিল। তবে ক্যাসকেডগুলো
বেশ চমৎকার। সামান্য কিছু সময় ট্রেইল করার পরই চোখ আটকায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা প্রকাণ্ড এক বাঁশঝাড়ের ওপর। আরেকটু সামনে যাওয়ার পরেই পতিত বাঁশঝাড়ের ফাঁক গলে চোখ পড়ে রিমঝিম ছন্দ তোলা ঝরনা। অবিরাম ধারায় বিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে কালাপানি ট্রেইলে গড়িয়ে যাওয়া শ্বেত শুভ্র শীতল পানির ধারা। হড়কাবান বা ফ্লাশ ফ্ল্যাডের আশঙ্কায় বাঁশঝাড় সরিয়ে ঝরনায় গোসল করার সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেওয়া হলো। বুনো নিসর্গ দেখতে গেলে এমন সতর্ক কিন্তু থাকতে হয় সব সময়। আমরা সেখানে বসে পড়লাম। নীরব পরিবেশে শুধু ঝরনার রিমঝিম শব্দ উপভোগ করলাম খানিকক্ষণ। ঘড়ির কাঁটা আমাদের জানান দিল, দুপুর গড়িয়েছে অনেক আগেই। তাই আর দেরি না করে ফিরতি পথ ধরি।