জুলাইয়ে সীমান্তে হত্যা ও পুশ ইন বেড়েছে: এমএসএফ


জুলাই মাসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মাধ্যমে সীমান্তে হত্যা ও দেশের ভেতরে লোকজনদের ঠেলে দেওয়া বা পুশ ইনের ঘটনা আগের মাসের চেয়ে বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা ও গণপিটুনির ঘটনা।
আজ বৃহস্পতিবার মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) দেওয়া জুলাই মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন ও মানবাধিকারকর্মীদের তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে সংগঠনটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি মাসে ফেনী, কক্সবাজার, দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, সাতক্ষীরা, কুড়িগ্রাম, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, মৌলভীবাজার, শেরপুর, হবিগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, জামালপুর ও লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে ধাপে ধাপে অন্তত ১ হাজার ৫৬২ জনকে বাংলাদেশের ভেতরে পুশ ইন করেছে বিএসএফ। গত জুনে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১০২ জন। জুলাইয়ে সীমান্তে বিএসএফের ছোড়া গুলিতে ছয়জন নিহত হন। গত জুনে এই সংখ্যা ছিল ২।
এমএসএফ বলছে, বিএসএফ কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না; বরং অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে গত দুই মাস থেকে শুরু হওয়া পুশ ইন বাংলাদেশে সীমান্তবর্তী নাগরিকদের মনে আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যাদের বাংলাদেশ ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশি হলেও বহু বছর ধরে ভারতে বসবাস করার কারণে সেখানে তারা নিবন্ধিত এবং তাদের পরিচয়পত্রও রয়েছে। ভারতের এ ধরনের আচরণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। বর্তমানে বাংলা ভাষাভাষীসহ সিলেট, মৌলভীবাজার ও শেরপুর জেলা দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পুশ ইন করা হচ্ছে। ভারতের একতরফা পদক্ষেপ স্বীকৃত প্রত্যাবাসন ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির লঙ্ঘন। ফলে সীমান্তে অস্থিতিশীল অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে।
এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৮টি ঘটনায় শিকার হয়েছে ৫৯৩ জন। তাদের মধ্যে ৯ জন নিহত এবং ৫৮৪ জন আহত হয়। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২১ জন গুলিবিদ্ধ হয়। বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বে তিনজন, জামায়াত ও বিএনপির সংঘর্ষে একজন বিএনপি কর্মী, গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন।
এমএসএফের পরিসংখ্যান বলছে, জুলাইয়ে গণপিটুনির ৫১ ঘটনায় ১৬ জন নিহত এবং ৫৩ জন আহত হন। গত জুন মাসে গণপিটুনির ঘটনা ছিল ৪১টি। এতে হতাহত হয়েছিলেন ৫৭ জন।
এ ছাড়া জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতার ঘটনায় আটটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মামলার আসামি সাবেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ মাসে করা কোটা আন্দোলনসংক্রান্ত আটটি মামলায় আসামির তালিকায় সুনির্দিষ্টভাবে নাম রয়েছে ১৪৯ জনের আর ১ হাজার ৭০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও সরকার পতন-সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ১৯৩ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া জুলাইয়ে সারা দেশে গ্রেপ্তার হন ৩৮ হাজার ১৬৭ জন।
এমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাইয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ১৯টি ঘটনায় ৩০ জন সাংবাদিক নানাভাবে হামলা, আইনি হয়রানি, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হন। আক্রান্ত সাংবাদিকদের মধ্যে ১২ জন সাংবাদিক আইনি হয়রানির শিকার হন, যাঁদের মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৪ জন সাংবাদিক তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আহত ও হামলার শিকার হন। লাঞ্ছিত ও হুমকির শিকার হন চারজন সাংবাদিক।
জুলাই মাসে ৩৫২টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, যা গত মাসের তুলনায় ১২টি কম। এই মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৫৬টি, দলবদ্ধ ধর্ষণ ১৮টি, ধর্ষণ ও হত্যা সাতটি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয় পাঁচজন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী।
এ ছাড়া জুলাইয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা সেনা অভিযান চলাকালে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলির একটি ঘটনায় দুজন নিহত হয়। এ মাসে কারা হেফাজতে ১০ জনের মৃত্যু হয়। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আটটি।
জুলাইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আটটি শিশু, একজন কিশোর, ১৩ জন নারী, ২৯ জন পুরুষসহ মোট ৫১টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার করা হয় বলে এমএসএফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।