শিরোনাম
পারমাণবিক বোমা পরীক্ষায় ভূকম্পন কেমন হয়ইউআইইউ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ঢাকা ব্লকেডের হুঁশিয়ারিচিরিরবন্দরে এনসিপির সমন্বয় কমিটিতে যুবলীগের নেতামমতার সঙ্গে ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের বৈঠক সোমবারইসরায়েলের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব থাকলেও, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে এগিয়ে ইরান: বিশেষজ্ঞকর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিচ্ছে ঢাবিইসরায়েলি আগ্রাসনে দিল্লির নীরবতা দুঃখজনক, ভারতীয় মূল্যবোধের পরাজয়‘ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যায় নয়, গুণে বিশ্বাসী ইরান, ইসরায়েল এবার আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখবে’ইরানে বোমা ফেলে গাজাকে বিশ্ববাসীর মন থেকে মুছতে চাইছেন নেতানিয়াহু: মার্কিন সিনেটরভাড়া বললে গালি, প্রতিবাদে মার! বরিশালে যাত্রা মানেই ঝুঁকি

ইসরায়েলি আগ্রাসনে দিল্লির নীরবতা দুঃখজনক, ভারতীয় মূল্যবোধের পরাজয়

ইসরায়েলি আগ্রাসনে দিল্লির নীরবতা দুঃখজনক, ভারতীয় মূল্যবোধের পরাজয়

চলতি বছরের ১৩ জুন বিশ্ব ফের একবার একতরফা সামরিক আগ্রাসনের ভয়াবহ পরিণতির সাক্ষী হলো। এদিন ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে এক অপ্রত্যাশিত ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী হামলা চালায় এবং দেশটির সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে।

এই বোমাবর্ষণ এবং ইরানি ভূখণ্ডে লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। দলটি বলেছে, এই ঘটনা ভয়ংকর রকমের উত্তেজনা বাড়িয়েছে, যার পরিণতি শুধু এই অঞ্চলের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যও বিপজ্জনক হতে পারে। গাজার বেলায়ও যেমন দেখা গেছে—ইসরায়েলের একের পর এক নির্লজ্জ ও অমানবিক হামলা এখন এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। (ইরানে) এই সাম্প্রতিক হামলাও প্রমাণ করেছে, তারা নিরীহ মানুষের জীবন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার তোয়াক্কা করছে না। এমন পদক্ষেপ কেবল অস্থিরতা আরও বাড়াবে এবং ভবিষ্যতে আরও সংঘাতের বীজ বপন করবে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—এই হামলা এমন এক সময় ঘটেছে, যখন ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনা আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি দেখাচ্ছিল। চলতি বছর ৫ দফা বৈঠক ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছিল এবং ষষ্ঠ দফা চলতি জুনেই হওয়ার কথা ছিল। এমনকি মার্চেও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালু করেনি এবং ২০০৩ সালের পর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এই কর্মসূচি পুনরায় শুরুর অনুমোদন দেননি।

এখানে উল্লেখ্য যে, বর্তমান ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের এক দীর্ঘ অতীত রয়েছে। তাঁর এই অতীত শান্তি প্রক্রিয়াকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে এবং চরমপন্থার পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। (ফিলিস্তিনে) তাঁর সরকারের অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ, উগ্র-জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে মৈত্রী এবং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে বাধা সৃষ্টি—সবকিছুই ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা বাড়িয়েছে এবং গোটা অঞ্চলকে চিরস্থায়ী সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়, ১৯৯৫ সালে প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন যখন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তখন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক উসকানিই তাঁর হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরি করেছিল। সেই সময়টিই ছিল শান্তির এক বড় সম্ভাবনা, যা নেতানিয়াহুর হীন রাজনীতিতে ভেস্তে যায়।

এই প্রেক্ষাপটে নেতানিয়াহুর পক্ষে যুদ্ধ বেছে নেওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি একসময় ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ ও সামরিক-শিল্প জোটের প্রভাবের সমালোচক ছিলেন, তিনিও এখন এই ধ্বংসাত্মক পথেই হাঁটছেন। অথচ, তিনিই ইরাক যুদ্ধের সময় মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র একটি ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু করেছিল—তা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

তবে, গত ১৭ জুন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন নিজ গোয়েন্দা প্রধানের মূল্যায়নকে উড়িয়ে দিয়ে বলেন যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর ‘অত্যন্ত কাছাকাছি’, তখন তা সত্যিই হতাশাজনক। আজকের বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে প্রত্যাশা—তারা যেন তথ্যভিত্তিক ও কূটনৈতিক পথে চলেন, বলপ্রয়োগ ও মিথ্যার ওপর নির্ভর না করেন।

অবশ্যই, ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগকে পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না। পারমাণবিক অস্ত্রধর ইরান নিয়ে তাদের উদ্বেগ বাস্তব। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দ্বিমুখী নীতি চলতে পারে না। ইসরায়েল নিজেই একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ, যার ইতিহাসে প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে বহুবার আগ্রাসন চালানোর দৃষ্টান্ত আছে। বিপরীতে, ইরান এখনো পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির সদস্য এবং ২০১৫ সালের চুক্তি (জেসিপিওএ)-এর আওতায় তারা কঠোরভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে সীমা মেনে চলেছিল, যার বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছিল। এই চুক্তি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য, জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্মতিতেই হয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা তা যাচাই করেছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ায়। সেই সিদ্ধান্ত বহু বছরের কূটনৈতিক পরিশ্রম ধ্বংস করে দেয় এবং গোটা অঞ্চলকে আবার অস্থিরতার মুখে ফেলে।

এই পরিস্থিতির প্রভাব ভারতও প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করেছে। ইরানের ওপর নতুন করে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ভারতের বেশ কিছু কৌশলগত ও অর্থনৈতিক প্রকল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যেমন—আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহন করিডর এবং চাবাহার বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, যা মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ ও আফগানিস্তানে পৌঁছার বিকল্প পথ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

ইরান ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধু। এই দুটি দেশের মধ্যে বহু প্রাচীন সভ্যতাগত বন্ধন আছে। ইরান অতীতে বহুবার ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে, এমনকি জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যুতে ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে ভারতের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব ঠেকাতেও তারা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ভারতের সঙ্গে অনেক বেশি সহযোগিতামূলক মনোভাব দেখিয়েছে। এমনকি ইসলামি প্রজাতন্ত্র তার পূর্বসূরি রাজতান্ত্রিক ইরানের চেয়ে বেশি ভারতের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব দেখিয়েছে। ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় তৎকালীন ইরানি রাজপরিবার পাকিস্তানের পক্ষে ঝুঁকে পড়েছিল।

অন্যদিকে, সাম্প্রতিক দশকে ভারত-ইসরায়েল সম্পর্কও গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মাত্রা পেয়েছে। এই দুই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে ভারত একটি অনন্য অবস্থানে আছে। যেখানে আমরা একটি ন্যায্য সেতুবন্ধনের ভূমিকা রাখতে পারি, উত্তেজনা প্রশমনে কূটনৈতিকভাবে মধ্যস্থতা করতে পারি। এটি শুধু নীতিগত প্রশ্ন নয়, বাস্তব প্রয়োজনও বটে। লাখ লাখ ভারতীয় পশ্চিম এশিয়ায় কাজ করছেন। ফলে এই অঞ্চলের শান্তি আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

আজ ইসরায়েল যেভাবে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, সেটি ঘটছে এক ধরনের দায়মুক্তির পরিবেশে, যেখানে পশ্চিমা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর প্রায় নিঃশর্ত সমর্থনই তাদের উৎসাহ জুগিয়েছে। কংগ্রেস আগেই অকপটে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ভয়াবহ ও অগ্রহণযোগ্য হামলার নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা এটাও বলি—ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়াও ছিল ভয়ংকর রকমের মাত্রাহীন এবং বিপর্যয়কর। ইতিমধ্যে ৫৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অনেকগুলো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পাড়া-মহল্লা ধ্বংস হয়ে গেছে। হাসপাতাল ধ্বংস করা হয়েছে। গাজা এখন দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে।

এই মানবিক বিপর্যয়ের মুখেও নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতের দীর্ঘদিনের ন্যায্য ও নীতিনিষ্ঠ অবস্থান থেকে একেবারে সরে এসেছে। স্বাধীন ও মর্যাদাসম্পন্ন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে যে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভারত বারবার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছে, সেটি আজ পুরোপুরি উপেক্ষিত।

গাজা ও ইরানের ওপর ইসরায়েলের এই একতরফা হামলার পরিপ্রেক্ষিতে নয়াদিল্লির (নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বর্তমান বিজেপি সরকারের) নীরবতা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই নীরবতা শুধু ভারতের কণ্ঠরোধ নয়, বরং আমাদের মূল্যবোধের পরাজয়ও বটে। তবে এখনো সময় আছে। ভারতকে অবশ্যই স্পষ্টভাবে অবস্থান নিতে হবে, দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে এবং সব কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা প্রশমনে কাজ করতে হবে—শান্তির পথে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

দ্য হিন্দু থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button