ইরান-ইসরায়েল সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে যেভাবে লাভবান হবে রাশিয়া


বিশ্ব যখন ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের আগুনের আঁচে ত্রস্ত, ঠিক তখনই ইউক্রেনে নতুন করে বড় ধরনের আক্রমণ চালিয়েছে রাশিয়া। এই হামলার লক্ষ্যবস্তু ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ। এ হামলায় অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছে। এই হামলার পর প্রশ্ন উঠেছে, রাশিয়া ঠিক এখনই কেন কিয়েভে এই বড় আকারের হামলা চালাল।
গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে এ হামলা চালানো হয়। কিয়েভ ছাড়াও দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ওডেসাতেও হামলা চালায় রুশ বাহিনী। কিয়েভের সামরিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কমপক্ষে ১৭৫টি ড্রোন, ১৪টি ক্রুজ ও ২টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। প্রায় ৯ ঘণ্টা ধরে হামলা চলে।
হামলার ধরন থেকে এটি স্পষ্ট যে, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি রাশিয়াকে ইউক্রেনে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর বড় কারণ, ইউক্রেনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশটির পশ্চিমা মিত্রদের মনোযোগে ঘাটতি। এই সুযোগে, রাশিয়া কিয়েভকে আরও ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলতে চাইবে, রণক্ষেত্রে আরও যত বেশি সম্ভব এলাকা দখল করতে চাইবে সেটিও নিশ্চিত।
কানাডায় চলমান শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭-এর শীর্ষ সম্মেলনে পুরো মনোযোগ ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে। সেখানে অন্য কোনো ইস্যু বলতে গেলে স্থানই পায়নি। বরং এই সম্মেলনে রাশিয়া এক অনাকাঙ্ক্ষিত পক্ষপাত পেয়ে গেছে। সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও রাশিয়াকে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭-এ ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন। তাঁর দাবি, রাশিয়াকে এই জোটে রাখা হলে ইউক্রেনে যুদ্ধ হতো না।
রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করলে প্রতিবাদ হিসেবে দেশটিকে জি-৮ থেকে বাদ দেওয়া হয়। সেই ঘটনার ১১ বছর পর ট্রাম্প রাশিয়ার পক্ষে এই মন্তব্য করলেন। রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘নিষেধাজ্ঞা আমাদের অনেক খরচ করায়। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা অনেক ব্যয়বহুল। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার চলে যায়।’ রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বাদ দেওয়াটা ছিল ‘একটা বড় ভুল’, এমন মন্তব্যও করেন তিনি।
ট্রাম্প বলেন, ‘এই যুদ্ধ (রাশিয়া-ইউক্রেন) হতো না। আপনার শত্রু যদি আলোচনার টেবিলে থাকে, তাঁকে তখন শত্রু বলাও ঠিক না। আমি তো ওঁকে (রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন) তখন শত্রুই ভাবিনি।’
এই সিদ্ধান্তের জন্য তিনি কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে দায়ী করেন। ট্রাম্প বলেন, ‘ওবামা ওঁকে (পুতিন) চাননি, আর আপনার দেশের প্রধানও চাননি।’ তিনি বারবার ট্রুডোর নাম নেন এবং রাশিয়াকে বাদ দেওয়াটাকে ভুল বলে উল্লেখ করেন।
ট্রাম্পের তরফ থেকে এই অপ্রত্যাশিত পক্ষপাত রুশ নীতিনির্ধারকদের মনোবলই বাড়াবে। কেবল তাই নয়, এর আগে ট্রাম্প জানিয়েছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যদি ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বন্ধে দূতিয়ালি করতে চায়, তবে তিনি সে বিষয়ে উন্মুক্ত। সব মিলিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পই কিয়েভে সর্বশেষ হামলায় রাশিয়াকে বাড়তি উৎসাহ জুগিয়েছেন—এটি অত্যুক্তি হবে না।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত থেকে রাশিয়া কীভাবে লাভবান হতে পারে সে বিষয়ে কথা বলেছেন আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো এবং জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটির শা’র স্কুল অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নমেন্টের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক মার্ক এন. কাৎজ।
কাৎজ বলেন, ‘ইসরায়েল-ইরান সংঘাত থেকে রাশিয়া সম্ভাব্য কিছু সুবিধা পেতে পারে। এর একটি হলো—যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ ও সমর্থন ইউক্রেন থেকে ইসরায়েলের দিকে সরে যাওয়া। আরেকটি হলো—তেলের দাম বৃদ্ধি, যা মস্কোকে ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থায়নের জন্য আরও বেশি সম্পদ সরবরাহ করবে। তবে, ইসরায়েল-ইরান সংঘাত দ্রুত শেষ হলে এসব সুবিধা দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে।’
ইরান-ইসরায়েল সংকট নিরসনে মধ্যস্থতার সুযোগ রাশিয়াকে কীভাবে লাভবান করতে পারে সে বিষয়ে কাৎজ বলেন, ‘এটি ইউক্রেনে যুদ্ধ চলাকালীনও ওয়াশিংটনের সঙ্গে রাশিয়ার সহযোগিতা বাড়ানোর যে লক্ষ্য পুতিনের, সেটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়।’ অর্থাৎ, এই বিষয়টিও রাশিয়ার অনুকূলেই যাচ্ছে।
কিন্তু, কিছু রুশ ভাষ্যকার উল্লেখ করেছেন, ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে ইরানের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঝুঁকিও রয়েছে। সিরিয়ার মতো এখানেও দীর্ঘদিনের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী সরকারের পতন ঘটতে পারে। এই প্রসঙ্গে এই বিশ্লেষক বলেন, ‘এরপর ইরানে যে নতুন কর্তৃপক্ষই আসুক না কেন, তাদের সঙ্গে প্রভাব বিস্তারের জন্য রাশিয়াকে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। তবে, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া ব্যস্ত থাকায় পুতিন এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থানে থাকবেন না।’
সুতরাং, ইসরায়েল-ইরান সংঘাত রাশিয়াকে কিছু সুবিধা দিলেও, এর গুরুতর ঝুঁকিও রয়েছে। পুতিনের কূটনৈতিক উপায়ে ইসরায়েল-ইরান সংঘাত অবসানের আহ্বান নিঃসন্দেহে তাঁর প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিফলন। তবে, পুতিন যেমনটা চান, রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ মধ্যস্থতা প্রচেষ্টার মাধ্যমে সংঘাত শেষ হলেও ইরান অতীতের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেশি সহযোগী হতে পারে।
এদিকে, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘর্ষ ব্যাপক আকার ধারণ করায় জ্বালানি তেলের দাম লাফিয়ে বাড়ছে। এটি রাশিয়ার জন্য কিছু স্বস্তি বয়ে এনেছে। কারণ, দেশটির সামরিক ব্যয় বাড়তে থাকায় চলতি বছরের বাজেট ঘাটতির আশঙ্কাও বাড়ছে। গত সপ্তাহের শেষে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭৮ ডলারে পৌঁছায়। জুনের শুরুতে ছিল ব্যারেলপ্রতি ৬৩ ডলার। অর্থাৎ, এক মাসের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে ১৩ জুন ইসরায়েলের হামলার তাৎক্ষণিক ধাক্কা সামলানোর পর দাম কমে ৭০ ডলারের ঘরে নামে। ঝুঁকির কারণে দাম কিছুটা বাড়লেও এখনো ইরানের তেল রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়নি।
রুশ গণমাধ্যম দ্য বেলের বিশ্লেষক দেনিস কাসিয়ানচুক এক মন্তব্যে বলেন, ‘ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ তেল বাজারের জন্য এক বড় পরীক্ষা। গত দেড় বছরে নানা উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরও বাজার যেন সবকিছুর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।’
সংঘাত শুরু হওয়ার আগে ব্রেন্টের দাম জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ ৮৩ ডলার থেকে কমে ৫৮ ডলারে নেমে আসে। ওপেক প্লাসের উৎপাদন কোটা বাড়ানো এবং বিশ্ববাজারে ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধের কারণে এই পতন ঘটে। এতে রাশিয়ার রাজস্ব এক-তৃতীয়াংশ কমে যায়। ফলে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট ঘাটতির পূর্বাভাস তিনগুণ বাড়িয়ে জিডিপির ১ দশমিক ৭ শতাংশ করেছে। এ সময় রাশিয়ার অর্থনীতি বাস্তব অর্থে সংকুচিত হয়েছে। এর আগের দুই বছর দেশটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
মে মাসের মাঝামাঝি থেকে বাজারে ইরানে ইসরায়েলি হামলার সম্ভাবনা হিসাব করে তেলের দাম আবার বাড়তে শুরু করে। তখন দাম ব্যারেলপ্রতি ৬৫ ডলারে স্থিতিশীল হয়। ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর দাম আবার বাড়লেও সেটি এখন কিছুটা কমেছে। এরপরও সংঘাত-পূর্ব সময়ের তুলনায় দাম এখনো বেশ বেশি।
তবে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়ার জন্য ভালো মনে হলেও দেশটির বাজেটের জন্য তখনই ইতিবাচক হবে যখন উচ্চ মূল্য দীর্ঘ সময় ধরে বজায় থাকবে। দ্য বেল উল্লেখ করেছে, ‘স্বল্পমেয়াদি বৃদ্ধি, যা বড় ধরনের অস্থিরতার সময় সব সময় ঘটে, কিন্তু সাধারণত দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে, এ ধরনের উল্লম্ফনের তেমন গুরুত্ব নেই।’
ক্রেমলিনের রাজস্বের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আনতে হলে ‘মূল্য দীর্ঘ সময়ের জন্য নতুন স্তরে স্থির রাখতে হবে।’ আর এর জন্য ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে হবে। কিন্তু বিশ্লেষকেরা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে—এমন সম্ভাবনার বিষয়ে বিভক্ত।
তবে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাত যে, ইউক্রেনের রণক্ষেত্রে রাশিয়াকে আপাতত বাড়তি রাজনৈতিক এবং কৌশলগত সুবিধা দিচ্ছে তা নিয়ে দ্বিমত নেই বিশ্লেষকদের। তবে ইরান থেকে রাশিয়ায় ড্রোন সরবরাহ বন্ধ হলে সেই সুবিধা স্তিমিত হতে পারে। কিন্তু সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী না হলে, সেই আশঙ্কা নেই বললেই চলে। এ ছাড়া, সাময়িকভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হবে।
কিন্তু যুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং ইরানের বর্তমান শাসনের পতন হয়, তাহলে সেটি রাশিয়ার জন্য ভূরাজনৈতিক অবস্থানে এক বড় ধাক্কা হবে। কারণ, গত বছরের ডিসেম্বরে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যে ইরানই রাশিয়ার একমাত্র অবশিষ্ট মিত্র।
তথ্যসূত্র: আটলান্টিক কাউন্সিল, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য বেল ও বিএনইন্টেলআইনিউজ
লেখক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক