শিরোনাম

বাংকার বাস্টার নাকি কূটনীতির পথে ট্রাম্প

বাংকার বাস্টার নাকি কূটনীতির পথে ট্রাম্প

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত গতকাল মঙ্গলবার পঞ্চম দিনে গড়িয়েছে। হামলা শুরু করা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দাবি, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করাই তাঁদের লক্ষ্য। তবে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের মতে, পাথুরে পাহাড়ের গহিনে লুকিয়ে থাকা ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের সক্ষমতা ইসরায়েলের নেই। তা আছে দেশটির প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের। দৃশ্যত এ কারণেই নেতানিয়াহু শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে এ সংঘাতে সরাসরি জড়ানোর চেষ্টা করছেন। এই অবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোন পথে হাঁটবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি কি কূটনীতির পথ বেছে নেবেন, নাকি ইসরায়েলের উসকানিতে বাংকার বাস্টার বোমা জোগাবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ইরানের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক কেন্দ্র কোম শহরের অদূরে অবস্থিত ফোরদোয়। এখানে পাথুরে মাটির অনেক নিচে আর কংক্রিটের পুরু আবরণের নিরাপত্তায় পরমাণু কর্মসূচি চলছে। তা ধ্বংস করার ক্ষমতা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকা সবচেয়ে শক্তিশালী ‘বাংকার বাস্টার’ বোমারই রয়েছে। তার কেতাবি নাম ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনেট্রেটর’ বা ‘জিবিইউ-৫৭’। এই বোমা ফেলতেও ব্যবহার করতে হবে বিশেষ ধরনের বি-২ বোমারু বিমান, যা ইসরায়েলের নেই।। ট্রাম্প যদি বাংকার বাস্টারের পথই বেছে নেন, তাহলে তাঁর দেশ মধ্যপ্রাচ্যের নতুন এই সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি আর ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো কোনো বিদেশি সংঘাতে জড়াবেন না।

মার্কিন কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, ট্রাম্প তাঁর মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফকে ইরানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। সম্ভবত ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সকেও বৈঠকে যোগ দিতে বলেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গত সোমবার তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে ‘তেহরানের সব বাসিন্দাকে অবিলম্বে সরে যেতে’ বলেন। ট্রাম্পের এই পোস্ট আভাস দিচ্ছে, নেপথ্যে বিশেষ কূটনৈতিক কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত অর্জিত হয়নি।

সোমবার রাতে হোয়াইট হাউস জানায়, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির কারণে কানাডায় চলমান জি৭ সম্মেলন থেকে আগেভাগেই দেশে ফিরছেন প্রেসিডেন্ট। সে সময় ট্রাম্প বলেন, ‘এখান থেকে বিদায় নিয়েই আমরা কিছু একটা করতে চলেছি। আমাকে যেতে হবে।’ তবে ট্রাম্প ঠিক কী করবেন, তা গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত পরিষ্কার হয়নি।

এদিকে সোমবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি এক বিবৃতিতে আভাস দিয়েছেন, তাঁরা আলোচনায় বসতে এবং চুক্তি করতে প্রস্তুত। আরাগচি বলেন, ‘নেতানিয়াহুর মতো ব্যক্তিকে থামাতে ওয়াশিংটন থেকে একটা ফোনকলই যথেষ্ট। সেটা করলেই কেবল কূটনৈতিক প্রচেষ্টা পুনরায় শুরুর পথ খুলবে।’

কিন্তু কূটনৈতিক প্রচেষ্টা যদি ব্যর্থ হয় কিংবা ইরানের শাসকগোষ্ঠী যদি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পুরোদমে বন্ধে রাজি না হয়, তাহলে কী ঘটবে? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো তখন ইরানের ফোরদো এবং অন্যান্য পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংসে বোমারু বিমান ওড়ানোর কথা ভাববেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ থেকে জো বাইডেন পর্যন্ত টানা চার সরকারের মেয়াদে মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু নিয়ে কাজ করেছেন ব্রেট ম্যাকগার্ক। তাঁর মতে, ‘ফোরদো সব সময়ই কঠিন এক সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। ইসরায়েলের অভিযান যদি ফোরদোকে ঠেকাতে না পারে, তাহলে কোনো কৌশলগত অর্জন থাকবে না।’

মার্কিন সামরিক বাহিনী ফোরদোর বিষয়টি মাথায় রেখেই দুই বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই প্রস্তুতিতে যেসব মহড়া হয়েছে তার সারমর্ম হলো, কেবল একটি বাংকার বাস্টার বোমা দিয়ে ফোরদো ধ্বংস করা সম্ভব নয়। কয়েকটি বি২ বোমারু বিমান থেকে নিখুঁতভাবে একই জায়গায় একের পর এক বোমা ফেলতে হবে। অর্থাৎ আগের বোমার সৃষ্টি করা গর্তে পরের বোমাটি পড়ে আরও তা গভীরে ঢুকবে। আর এ অভিযানে মার্কিন পাইলট ও ক্রুদের সরাসরি অংশ নিতে হবে।

গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পর্যন্ত মার্কিন সামরিক বাহিনীর সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিকল্পনায় এটাই ছিল। কিন্তু এর মধ্যেই নেতানিয়াহু ‘ইসরায়েলের জন্য বিপদ আসন্ন’ দাবি করে ইরানে হামলার নির্দেশ দেন। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানীরা দ্রুত একটি বোমা বানানোর চেষ্টা করছেন ঠিকই। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁরা বড় কোনো সাফল্য পাননি। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও ব্রেট ম্যাকগার্কের সুরে সুর মিলিয়ে বলেছেন, ফোরদো যদি এবারের সংঘাতে টিকে যায়, তাহলে ইরান ঠিকই একদিন পারমাণবিক বোমার অধিকারী হবে। তবে তার আগে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত পারমাণবিক অবকাঠামোগুলো মেরামত ও পুনর্গঠন করতে হবে।

ট্রাম্পের সামনে বোমা ছাড়াও আরেকটি বিকল্প রয়েছে। কিন্তু সেই বিকল্প কতটা সফল হবে, তা বলা কঠিন। ফোরদোর বিদ্যুৎ-সংযোগ কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন করা গেলে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ সেন্ট্রিফিউজগুলো ধ্বংস করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বলেছে, এরই মধ্যে সম্ভবত বড় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতাঞ্জে এ ঘটনা ঘটেছে। গত শুক্রবার ইসরায়েলি হামলায় নাতাঞ্জের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্র ২০০৪ সালে বাংকার বাস্টার তৈরি শুরু করে। লক্ষ্য ছিল, তা দিয়ে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার পাহাড়ে লুকানো সুরক্ষিত পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করা। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে এই বোমার প্রথম পরীক্ষা করা হয় এবং সামরিক বাহিনীতে এটি যুক্ত হয়। নেতানিয়াহু জর্জ বুশের সময় থেকেই তাঁদের বাংকার বাস্টার দেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছেন। এ পর্যন্ত তিনি সফল না হলেও চাপ এখন অনেক বেড়েছে। নেতানিয়াহুর সঙ্গে বিরোধের জেরে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করা জোয়াভ গালান্ট সোমবার সিএনএনকে বলেছেন, ‘কাজটা করতেই হবে, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রকেই করতে হবে।’ মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম গত রোববার সিবিএসকে বলেছেন, ‘কূটনীতি সফল না হলে তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাবেন, যাতে এই অভিযান শেষে ইরানে পরমাণু কর্মসূচির ছিটেফোঁটাও না থাকে। তার অর্থ যদি হয় বোমা (বাংকার বাস্টার) সরবরাহ করা, সেটাই করতে হবে।’

কিন্তু সব রিপাবলিকান লিন্ডসে গ্রাহামের সঙ্গে একমত নন। দলের যুদ্ধবিরোধী অংশটি মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়ালে তার ফল ইরাক ও আফগানিস্তানের মতো হতে পারে। অর্জনের বদলে তা বোঝা হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন রাজনৈতিক ভাষ্যকার টাকার কার্লসন গত শুক্রবার রিপাবলিকান পার্টির যুদ্ধবিরোধী এই অংশের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেছেন, ‘ইসরায়েলকে ত্যাগ করো, ওদের যুদ্ধ ওদেরই লড়তে দাও।’



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button