পল্টনে রুদ্ধশ্বাস কয়েক ঘণ্টা


আমি তখন পল্টন এলাকায়। সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আগের দিন ৪ আগস্ট রাজধানীসহ দেশজুড়ে সহিংসতায় বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন শেখ হাসিনার পতনের এক দফায় পরিণত হয়ে উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলেছিল। আগুন, গুলি, কাঁদানে গ্যাসের শেলের শব্দ ঢাকাকে পরিণত করেছিল যেন বিপজ্জনক মৃত্যুপুরীতে।
সেদিন আমার অ্যাসাইনমেন্ট ছিল রাজধানীর পল্টন, বায়তুল মোকাররম ও প্রেসক্লাব এলাকায়। জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলনের সময় নিজ চোখে দেখেছি রাস্তায় কীভাবে গুলি লেগে কাতরাচ্ছেন বিক্ষোভে যোগ দেওয়া মানুষ। কীভাবে রক্তে ভিজে যায় কালো পিচের রাজপথ। সাংবাদিক হলেও তাই চরম উত্তেজনায় ভরা সেদিন ভেতরে ভেতরে কাজ করছিল একটা অজানা আতঙ্ক।
সেদিন সকালের দিকে এমনিতে জনারণ্য, কর্মব্যস্ত পল্টন ছিল প্রায় জনশূন্য। তবে আমার মনে হচ্ছিল, এ নীরবতার ভেতরে ভেতরে কিছু একটা চলছে। কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ফোনে একের পর এক খবর আসছিল—আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের ডাকে ঢাকা আসছে মানুষ। দক্ষিণে যাত্রাবাড়ী, উত্তরে উত্তরায় জড়ো হচ্ছেন চারপাশ থেকে আসা মানুষ। কিন্তু পুলিশের ব্যারিকেডের কারণে তখনো শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঢুকতে পারছেন না তাঁরা।
সহযোগী একটি পত্রিকার এক সাংবাদিক তাঁর পরিচিত কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে এ সময় সতর্ক করে বলেন, ‘পল্টন ছেড়ে দাও, বিপদে পড়বা।’ প্রায় একই সময়ে পুলিশের একটি ভ্যানে তুলে নেওয়া হয় তিনজনকে।
দুপুরের পর ফোনে অজানা নম্বর থেকে একটি খুদে বার্তা আসে, ‘ঝামেলা হবে নিরাপদে থাকো’। চিফ রিপোর্টারকে ফোনে বিষয়টি জানালে তিনি অদূরে থাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অবস্থান নেওয়ার পরামর্শ দেন। আমরা কয়েকজন রিপোর্টার সেখানে চলে যাই। একপর্যায়ে একজন জানালেন, সেনাপ্রধান বেলা ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। আমরা বুঝে যাই বড় কিছু ঘটে গেছে বা ঘটতে যাচ্ছে।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বেলা ২টায় সেনাপ্রধানের ভাষণ দেওয়ার কথা শোনা গিয়েছিল; কিন্তু তা শুরু হয় সাড়ে ৩টার দিকে। ডিআরইউর বড় স্ক্রিনের সামনে শত শত রিপোর্টার রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষায় বসে। উপস্থিত সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলঘেঁষা হিসেবে পরিচিত কেউ চোখে পড়ল না। অন্য শিবিরের যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকের মুখেই চওড়া হাসি।
বাইরে চলতে থাকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে সেনাপ্রধানের ভাষণ শুরু হয়। আমরা জেনে গেলাম দেড় দশকের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার শাসনের অবসান ঘটেছে। চারদিকে শুরু হয় আনন্দধ্বনি।
রিপোর্টার্স ইউনিটি থেকে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগের দিকে গেলাম। ততক্ষণে সেখানে লাখো মানুষ জড়ো হয়েছে। কেউ মিষ্টি বিতরণ করছেন, কেউ আনন্দে কাঁদছেন।