‘ঈশ্বরের আদেশে’ বানানো এক কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম




ওপেন সোর্স আন্দোলনের জগৎ রঙিন চরিত্র আর ব্যতিক্রমী কাহিনিতে ভরা। তবে এসবের ভিড়ে সবচেয়ে বিস্ময়কর যেসব গল্প পাওয়া যায়, সেটি নিঃসন্দেহে অপারেটিং সিস্টেম টেম্পলওএস–কে ঘিরে। এই সিস্টেম তৈরির কাহিনি একই সঙ্গে অদ্ভুত, অবাক করা ও বিষণ্ন।
টেম্পলওএস–এর নির্মাতা টেরি এ. ডেভিস। তিনি, একজন মার্কিন সফটওয়্যার ডেভেলপার ছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, ঈশ্বর তাঁকে এই অপারেটিং সিস্টেম বানাতে বলেছিলেন। তাঁর তৈরি এই সিস্টেমে রয়েছে অদ্ভুত সব বৈশিষ্ট্য—নেই কোনো নেটওয়ার্ক সুবিধা, স্ক্রিন রেজল্যুশন ৬৪০ x ৪৮০ পিক্সেলস এবং এতে মাত্র ১৬টি রং ব্যবহার করা হয়েছে। ডেভিস বলেছিলেন, ঈশ্বরই তাঁকে এভাবে বানাতে নির্দেশ দিয়েছেন।
সবকিছু একাই বানিয়েছেন ডেভিস
টেরি ডেভিস টেম্পলওএস-এর প্রতিটি লাইন কোড নিজে লিখেছেন। এমনকি তিনি নিজস্ব এক প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজও তৈরি করেন—‘হলিসি’ (HolyC) নামে। ডেভিস বিশ্বাস করতেন, তিনিই বিশ্বের সেরা প্রোগ্রামার। এমনকি তিনি বলেছিলেন, ‘পোপ কম্পাইলার লেখেননি, তবে আমি লিখেছি, তাই আমি পোপের চেয়েও ভালো।’
টেরি এ. ডেভিস ছিলেন একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও প্রোগ্রামার। তাঁর জন্ম উইসকনসিনে হলেও পরবর্তী সময়ে তিনি ওয়াশিংটন, মিশিগান, ক্যালিফোর্নিয়া ও অ্যারিজোনায় বসবাস করেছেন। স্কুলে পড়াকালীন তিনি ১৯৭৭ সালের অ্যাপল কম্পিউটারে কাজ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে কমোডর ৬৪-তে অ্যাসেম্বলি ভাষা শেখেন।
ডেভিসের ছিল ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি, এবং তিনি ভিএএক্স (VAX) কম্পিউটারে দীর্ঘ সময় ধরে প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করেছিলেন।
এত দিন পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও, ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি এসে তাঁর জীবনে এক নাটকীয় এবং দুর্ভাগ্যজনক মোড় নেয়। সেই সময় তিনি মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়েন এবং একের পর এক ম্যানিক এপিসোডে ভুগতে থাকেন। অবস্থা এতটাই গুরুতর হয়ে ওঠে যে, তাঁকে বারবার মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
এই সময় তিনি সন্দেহে ভুগতে শুরু করেন—বিশ্বাস করতেন, এলিয়েনরা ও সুট পরা লোকেরা তাঁর পেছনে লেগে আছে। তিনি মনে করতেন, সিআইএ তাঁর ওপর নজর রাখছে। তিনি ভাবতেন, তাঁর জীবন জনপ্রিয় সিনেমা ‘দ্য ট্রুম্যান শো’ এর সিনেমার মতো, যেখানে প্রধান চরিত্রটি বুঝতেই পারে না যে তার পুরো জীবন একটি টেলিভিশন শো হিসেবে সম্প্রচার হচ্ছে।
এই মানসিক অবস্থার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় যখন তিনি হঠাৎ গাড়ি চালিয়ে দেশজুড়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন, নিজ গাড়ি খুলে খুঁজতে থাকেন ট্র্যাকিং ডিভাইস, এবং একসময় মরুভূমিতে ঘোরাঘুরির সময় পুলিশ তাঁকে আটক করে। সেখান থেকে পালানোরও চেষ্টা করেন তিনি।

অবশেষে তাঁর সিজোফ্রেনিয়া ধরা পড়ে। এই মানসিক অবস্থা তাঁকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করার অক্ষম করে তোলে, এবং শেষ পর্যন্ত তিনি আবার তাঁর পিতামাতার সঙ্গে থাকতে শুরু করেন, সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা নিয়েই চলতে থাকেন।
যদিও অনেক সময় তাঁর কথা অসংলগ্ন শোনাতো, তবে কম্পিউটার এবং প্রোগ্রামিংয়ের বিষয়ে তিনি ছিলেন স্পষ্ট ও দক্ষ।
ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা: বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি
টেম্পলওএস চালু করলে প্রথমেই ব্যবহারকারীকে স্বাগত জানানো হয় এক স্ক্রিনে, এরপর রয়েছে নিজস্ব বুটলোডার। কারণ ডেভিস লিনাক্স ও জিআরইউবি (GRUB) বুটলোডার অপছন্দ করতেন। সিস্টেমে প্রবেশের পর ব্যবহারকারী চাইলে পুরো অপারেটিং সিস্টেম কি আছে দেখে নিতে পারেন, যেটি নতুনদের জন্য সহায়ক হতে পারে। তবে মূল ব্যাপার হলো–হলিসি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ শেখা—কারণ এর টার্মিনাল এ ভাষার ওপর ভিত্তি করেই চলে।
হলিসি-এর একটি বিশেষ দিক হলো—যেসব ফাংশনে কোনো আরগুমেন্ট লাগে না, সেগুলো প্যারেনথেসিস ছাড়াই চলতে পারে। যেমন, Dir () ; লেখা যায় শুধু Dir; হিসেবেও।
নেভিগেশনের জন্য ব্যবহার করতে হয় Cd (“[folder]”) ; এবং ফোল্ডার কনটেন্ট দেখতে Dir;। ফোল্ডার স্ট্রাকচার অনেকটা উইন্ডোজের এর মতো, তবে এখানে ব্যাকস্ল্যাশ (\) নয়, ফরোয়ার্ড স্ল্যাশ (/) ব্যবহার হয়।

ধর্মীয় রেফারেন্স ও এলোমেলো শব্দ
ডেভিস ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান। তাই সিস্টেমেও রয়েছে অনেক ধর্মীয় রেফারেন্স। যেমন, Shift+F 7 চাপলে একটি বাইবেলের উক্তি দেখা যায়, আর F7 চাপলে দেখায় ‘ঈশ্বরের বাণী’, যদিও সেটি আসলে একটি এলোমেলো (র্যান্ডম) শব্দ জেনারেটর। ডেভিস বিশ্বাস করতেন, এই শব্দগুলো ঈশ্বরের পক্ষ থেকেই আসছে।
ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন
একজন ব্যবহারকারীর ভাষ্যে, টেম্পলওএস আসলে তেমন ব্যবহারযোগ্য নয়। এটি বেশ ত্রুটিযুক্ত এবং অনেক সময় হঠাৎ করে অদ্ভুত আচরণ করে। কখনো কী-বোর্ডের কোনো বাটন কাজ করে না, কখনো আবার কোনো অজানা কাজ শুরু হয়ে যায়। যদিও পুরো সিস্টেমটি ১০০ শতাংশ ওপেন সোর্স এবং এর সোর্স কোড দেখা যায় ‘C:/Adam’ ফোল্ডারে।
ব্যবহারকারীর মতো, এটি আসলে এক কৌতূহল জাগানিয়া প্রকল্প, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। এটি শেখা কঠিন, এবং ব্যবহারের জন্য তেমন আনন্দদায়কও নয়।
টেরি ডেভিস, যার মানসিক অসুস্থতা তাঁকে পরিবার থেকে আলাদা করে দেয়, শেষ জীবনে গৃহহীন হয়ে পড়েন। ২০১৮ সালে একটি দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। ধারণা করা হয়, এটি একটি আত্মহত্যা ছিল।
তাঁর তৈরি ওয়েবসাইট আজও সচল রয়েছে, যেখানে সিস্টেমটির ডাউনলোড লিংকও পাওয়া যায়।
তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে ইউটিউবে এ রয়েছে টেম্পলওস আর্কাইভ নামের একটি চ্যানেল, যেখানে সংরক্ষিত আছে টেরি ডেভিসের ভিডিও ও লাইভ স্ট্রিম।