শিরোনাম

দান মানে আত্মপ্রকাশ নয়, আত্মত্যাগ

দান মানে আত্মপ্রকাশ নয়, আত্মত্যাগ

দান—হৃদয়ের এক অনুপম ভাষা। এমন এক ভাষা, যা কোনো শব্দ ছাড়াই মানবতার অন্তরে গভীর রেখাপাত করে। দান কখনো সম্পদের হ্রাস নয়; বরং তা আত্মার প্রশান্তি, হৃদয়ের প্রশস্ততা ও প্রকৃত সমৃদ্ধির দুয়ার। দান মানুষের অন্তরের সেই বন্ধ দরজাটি খুলে দেয়, যেখানে বাস করে ভালোবাসা, করুণা আর সহানুভূতি।

দানের মাধ্যমে মানুষ আপন স্বার্থের সীমানা ছাড়িয়ে অপরের সুখ-দুঃখে একাকার হয়ে যায়। ধনী-গরিবের মাঝে গড়ে ওঠে আত্মিক মেলবন্ধন। কখনো একটি ছোট্ট দান কারও জীবনে বড় কল্যাণের কারণ হয়ে ওঠে, কখনো হয় কারও মুখে হাসির উৎস। দানের সৌন্দর্য এখানেই—দানকারী হয়তো ভুলে যায়, কিন্তু প্রাপক তা জীবনভর মনে রাখে।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজকের সমাজে দানের এই মহান সৌন্দর্যের দাগ লেগেছে। কিছু মানুষ দানের মুখোশ পরে মানুষের হৃদয়ে আঘাত করে, করুণার নামে ফাঁদ পাতে, দানের আগে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে। তারা মানুষকে এমন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করায়, যেন দয়া পাওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য দরিদ্রকে তাদের কঠিন মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে হবে। এটি ইসলামের শিক্ষা নয়। এটি মানবতারও শিক্ষা নয়।

রাসুলুল্লাহ (সা.) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘তোমরা সহজ করো, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, মানুষকে বিমুখ করো না।’ (সহিহ্ বুখারি: ৬৯৩৮, সহিহ্ মুসলিম: ১৭৩৪)

যারা দানের আগে মানুষকে প্রশ্নের বেড়াজালে আবদ্ধ করে, তারা তো কাজটিকে কঠিনই করে তুলেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি সুস্পষ্ট অন্যায়। মানুষের গোপন দোষ খোঁজা কিংবা তাকে অপমান করার কোনো অধিকার কারও নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের পার্থিব কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার আখিরাতের কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। যে ব্যক্তি অন্যের কষ্ট সহজ করে দেবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার কষ্ট সহজ করে দেবেন। বান্দা যতক্ষণ তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকবে, আল্লাহও ততক্ষণ তাকে সাহায্যের চাদরে ঢেকে রাখবেন।’ (সহিহ্ মুসলিম: ২৬৯৯)

আজ আমরা দেখতে পাই, কিছু মানুষ দানের নাম করে, দানপ্রার্থীকে প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তার দুঃখ-ব্যথার গভীরতা যাচাই করতে চায়। এ যেন দানের আড়ালে অপমানের নির্মম খেলা। এটি কি সত্যিই দান? এটি কি করুণা, না নির্মমতার মুখোশ? হাদিসে এসেছে, ‘কেয়ামতের দিন জাহান্নামিদের মধ্যে প্রথম বিচার হবে তিনজনের। তাদের একজন হলো সেই ব্যক্তি, যে দান করেছিল শুধু লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে। তার এই দান তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে।’ (জামে তিরমিজি: ২৩৮২)

তাদের প্রশ্ন কি সত্যিই দরিদ্রের উপকারের জন্য? নাকি নিজেদের খ্যাতি ও বাহবা অর্জনের জন্য? দান যদি মানুষের সম্মানহানি ঘটায়, তবে তা বাহ্যিক দান বই কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে তা এক আত্মগর্বিত প্রদর্শনী মাত্র। এ যেন করুণার মশালের নিচে আঁধারের ছায়া।

দান করতে গিয়ে কখনো মানুষকে হেয় করা যাবে না, এমনকি এমন আচরণও করা যাবে না, যাতে অন্য কারও জন্য তাকে হেয় করার আশঙ্কা তৈরি হয়।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা একে অপরকে হেয় করো না। এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার ভাইয়ের ওপর জুলুম করবে না, তাকে অপমান করবে না, তাকে হেয় করবে না।’ (সহিহ্ মুসলিম: ৬৪৩৫)

দান—গোপন ইবাদত:

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান করো, (যদি লোক দেখানোর জন্য না হয়), তবে তা-ও ভালো। আর যদি গোপনে দান করো এবং গরিবদের দাও, তবে এটি তোমাদের জন্য অধিক উত্তম।’ (সুরা বাকারা: ২৭১)

ইসলামে গোপনে দান করাই সর্বোচ্চ মহত্ত্বের কাজ। তাই দানের আগে প্রাপককে প্রশ্নবানে জর্জরিত করা, পরীক্ষা করা কিংবা তার আত্মসম্মানে আঘাত হানার মতো কোনো কাজ করা ইসলামের শিক্ষা নয়। দান কখনো কারও আত্মমর্যাদা ভাঙার বাহানা হতে পারে না। দান হলো করুণা, দান হলো সহানুভূতি, দান হলো হৃদয়ের নিঃশব্দ ভালোবাসা।

যারা দানের আড়ালে মানুষের আত্মাকে পিষে ফেলে, যারা করুণার প্রদীপের নিচে আঁধারের ছায়া সৃষ্টি করে—তাদের দান আসলে দান নয়, তা তো এক ঘৃণ্য আত্মপ্রদর্শনীর মাত্র।

তাই হে সমাজ, হে দানবীর, হে মানবতার আলো বহনকারী! দান করো—কোনো প্রশ্ন ছাড়াই। দান করো—কিন্তু মানুষের হৃদয় ভাঙো না। দান করো—কিন্তু সম্মানের দেয়াল ভেঙে দিও না। মনে রেখো—দান মানে করুণা, দান মানে শ্রদ্ধা, দান মানে ভালোবাসা। দান হোক এমন এক মশাল—যা আলোকিত করে দেয় মানুষের অন্তর, যেখানে প্রশ্নের কোনো অন্ধকার ছায়া নেই। দান হোক হৃদয় থেকে হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়া এক গোপন ভালোবাসার ধারা।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে এমন দানের তৌফিক দিন, যা মানুষের সম্মান বাঁচায়, যা আল্লাহর কাছে কবুল হয় এবং যা আমাদের জান্নাতের পথে এগিয়ে দেয়।

লেখক: মুফতি আহমাদুল্লাহ মাসউদ; শিক্ষক, জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া, কামরাঙ্গীরচর, ঢাকা।


ক্রাইম জোন ২৪

আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button