৬০১ কোটির প্রকল্প ৪ বছরে বেহাল


৬০১ কোটি টাকার প্রকল্প। ১০ ভবনে নির্মিত হয়েছে ৭৩৬ আবাসিক ফ্ল্যাট। সময় পাঁচ বছরও গড়ায়নি, এরই মধ্যে ফ্ল্যাটগুলোতে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কারণ, ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে এসব ফ্ল্যাট। কোনো ভবনে ফাটল ধরেছে, টোকা দিলেই খসে পড়ছে প্লাস্টার। কোথাও আবার বৃষ্টি হলেই ছাদ চুইয়ে পড়ে পানি। স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়েছে বাথরুম ও রান্নাঘরের দেয়াল। ফ্ল্যাটের বেসিন খুলে পড়ছে, ক্ষয়ে পড়ছে টয়লেটের পাইপও। এমন বেহাল চিত্র রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্পের।
সরকারি পূর্ত কার্যক্রমে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের অন্যতম উদাহরণ এই প্রকল্প। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মূলত মানহীন নির্মাণ উপকরণের ব্যবহার এবং ঠিকাদারের দায়সারা কাজের কারণেই পাঁচ বছর না পেরোতেই বসবাসের উপযোগিতা হারাচ্ছে প্রকল্পের ফ্ল্যাটগুলো। এ কারণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ করা এসব ফ্ল্যাটে থাকার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। নিয়ম ভঙ্গ করে বেসরকারি ব্যক্তিকে বাসা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। তারপরও ফাঁকা রয়েছে ৪৭টি ফ্ল্যাট।
প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে ভবনগুলো। দুর্নীতির দায়ে বর্তমানে কারাবন্দী ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম ও তাঁর সহযোগীরা ভবনগুলো তৈরি করেছেন।
জানতে চাইলে প্রকল্পটির সর্বশেষ পরিচালক (পিডি) ও সাবেক সাভার গণপূর্ত সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শংকর কুমার মালো বলেন, প্রকল্প তৈরির আগেই স্টোন চিপস, ইট-বালু, সিমেন্টসহ সব মালামাল বুয়েট থেকে পরীক্ষা করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিস্ত্রির কাজের ত্রুটির কারণে পানির লাইনের ফিটিংস লিক করে এবং আর্দ্রতার কারণে দেয়ালের প্লাস্টারের ক্ষতি হয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিন প্রকল্প এলাকায় দেখা যায়, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৭৩৬টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ’ প্রকল্পের প্রধান গেটের নামফলক ভাঙা।
গেট দিয়ে ঢুকতেই হাতের ডানে নিরাপত্তাপ্রহরীর কক্ষ, তার সামনে মসজিদ, মসজিদের পরেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু ভবন। ভবনের আশপাশের স্থানগুলো অপরিষ্কার। ম্যানহোলের ঢাকনাগুলো খোলা, রাস্তাগুলো স্যাঁতসেঁতে। ওই আবাসন প্রকল্পের ভেতরে দুটি খেলার মাঠ থাকলেও দুটির কোনোটিতে নেই স্টিলের বাউন্ডারির তারের জয়েন্ট। নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে লাইটগুলো।
প্রকল্পের ১ নম্বর ভবনে ঢুকতেই চোখে পড়ে ভবনের নিচতলার সামনের টাইলসগুলো ভাঙা, ওয়াল থেকে খসে পড়েছে প্লাস্টার, ভবনের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরেছে। পরিচয় দিয়ে সামনে এগোতেই নিরাপত্তাপ্রহরী বাধা দেন। তবে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ভবনের কয়েকজন বাসিন্দা তাঁদের কয়েকটি ফ্ল্যাট ঘুরিয়ে দেখান। সেই ফ্ল্যাটগুলোর ভেতরে কোথাও শয়নকক্ষের দেয়াল ড্যাম্প, কোথাও বাথরুমের টাইলস খুলে পড়েছে। এক নম্বর ভবনের মতোই অবস্থা ২ ও ৩ নম্বর ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটের।
জানতে চাইলে ৩ নম্বর ভবনের তত্ত্বাবধায়ক কাজী ইমরান আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই ভবনের অধিকাংশ বাসিন্দা এনএসআই কর্মকর্তা। ভবনের নির্মাণকাজ এত বাজে হয়েছে যে দেয়ালে একটু আঘাত করলেই প্লাস্টার খসে পড়ছে। দরজার লকগুলো খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। ৮০ শতাংশ লাইটই নষ্ট। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ১১ তলার একটি ফ্ল্যাটের বেডরুমে প্লাস্টার খুলে পড়েছে। বাথরুম ও কিচেনের অবস্থা আরও খারাপ। এখানে যে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, তা খালি চোখেই বোঝা যায়।’
প্রকল্পের ৪ নম্বর ভবনে গিয়ে দেখা যায়, পয়োনিষ্কাশন পাইপের একাংশ খোলা, রেলিঙের পাশ ভেঙে গেছে। ৫নং ভবনের বাথরুমের ভেতরের টাইলস খুলে পড়েছে, বেডরুমের দেয়ালও ড্যাম্প হয়ে গেছে। সামনে একটু এগোতেই ৬ নম্বর ভবন। এই ভবনের নিচতলার ফ্লোরের টাইলসগুলো ভেঙে গুঁড়া হয়ে গেছে।
জানতে চাইলে সেখানকার বাসিন্দা আশিক রাব্বানী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সরকারি ভবন নির্মাণের এই প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। আমাদের ভবনের নিচতলার টাইলসগুলো ভেঙে গুঁড়া হয়ে গেছে। ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে প্লাস্টার খুলে পড়ছে। এমন অনিয়ম হয়েছে যে বাসার বেসিনগুলোও খুলে পড়ছে।’
একই চিত্র দেখা গেছে ৯ নম্বর ভবনেও। ভবনটির কয়েকটি ফ্লোরের রান্নাঘরের টাইলস খুলে গেছে। বেডরুমের দেয়াল পুরো ভিজে ড্যাম্প হয়ে গেছে।
৫ ও ৬ নম্বর ভবনের বাসিন্দা রবিন হাসান ও সুজন কৈরি আজকের পত্রিকাকে বলেন, নষ্ট হওয়া ফ্ল্যাটগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না ঠিকমতো। এগুলো দ্রুত মেরামতের উদ্যোগ নিতে হবে।
এই প্রকল্পের ভবনগুলোর বাহ্যিক নকশা ও অবকাঠামো দৃষ্টিনন্দন হলেও অভ্যন্তরীণ গুণগত মানে কিছু ঘাটতি রয়েছে বলে উঠে এসেছে সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে। গত জুলাই মাসের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের ২৫ শতাংশ ফ্ল্যাটের বাথরুমের দেয়ালে ড্যাম্প, ১০ শতাংশের টাইলস খুলে পড়েছে এবং ২০ শতাংশের বেড ও ড্রয়িংরুমে প্লাস্টার খসে পড়ছে। এতে আরও বলা হয়, ভবনের লিফট ও ওয়াটার পাম্প অকার্যকর, ইন্টারকম ও সিসিটিভি ক্যামেরা অপ্রতুল এবং অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইন্টারকম সুবিধা ৭০ শতাংশ ভবনেই নেই। যেসব ভবনে আছে সেখানেও তা কার্যকর নয়। সব ভবনেই সিসি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। তবে ৩ ও ১০ নম্বর ভবন ছাড়া সব ভবনের সিসি ক্যামেরা অকার্যকর। জেনারেটর সুবিধা বিদ্যমান থাকলেও ৭০ শতাংশ ভবনে তা অটোমেটিক চালু হয় না।
প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী, ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকায় দুটি জিপ গাড়ি ও তিনটি মোটরসাইকেল কেনা হয়েছিল প্রকল্পের জন্য। অথচ এই যানবাহনগুলোর কোনো হদিস নেই।
প্রকল্পটির সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব মো. কামাল উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, আমরা অনিয়মের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান।
নির্মাণের চার বছরের মাথায় সরকারি এই আবাসন প্রকল্পের এমন বেহাল দশা হওয়ায় প্রশ্ন উঠছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজের মান এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের তদারকি নিয়ে। সরকারি ভবন নির্মাণে মান নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা না থাকলে ভবিষ্যতেও এমন ব্যয়বহুল প্রকল্প ব্যর্থতায় পরিণত হবে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ভবন কিংবা রাস্তাঘাট নির্মাণের প্রকল্পগুলোয় সাধারণত ওভার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে মূল্য বাড়িয়ে লোপাট করা হয়। এই প্রকল্পে মূল্য বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা তো করা হয়েছেই, তার ওপর মালামালেও ভেজাল মেশানো হয়েছে। সরকারের উচিত, যাঁরা এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা। এই প্রকল্পের পাশাপাশি নতুন করে কোনো প্রকল্পে যাতে এ ধরনের অনিয়ম না হয়। তার জন্য অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে আরও নজরদারি বাড়াতে হবে।
প্রকল্পে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার।
সাভার গণপূর্ত সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ বদরুল আলম খান বলেন, বাসিন্দাদের অভিযোগগুলো দেখেছি, দুই মাস পরপর সমস্যাগুলো নিয়ে সভা হবে। সভার পরামর্শের আলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে।
ক্রাইম জোন ২৪