‘ক্ষমতাসীনদের চাপে’ আলোরমুখ দেখেনি অধিকাংশ মামলা


কুষ্টিয়ায় গত দেড় দশকে সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হত্যার ডজনখানেক ঘটনা ঘটেছে। তবে অধিকাংশ মামলার বিচারপ্রক্রিয়া আলোর মুখ দেখেনি। বেশির ভাগ মামলাই ক্ষমতাসীনদের চাপে মাঝপথে থমকে গেছে। বেশ কয়েকটি মামলা তদন্ত পর্যায়ে আটকে রয়েছে। মানবাধিকার ও সাংবাদিক সংগঠনগুলোর দাবি, বিচারহীনতার এ সংস্কৃতি অপরাধীদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে। যে জন্য সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে।
২০২২ সালের ৩ জুলাই রাতে কুষ্টিয়া শহরের সিঙ্গার মোড়ের পত্রিকা অফিস থেকে মোবাইল ফোনে কল পেয়ে বের হন হাসিবুর রহমান রুবেল। ৭ জুলাই কুমারখালী পৌরসভার তেবাড়িয়া এলাকায় গড়াই নদে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ৮ জুলাই তাঁর চাচা মিজানুর রহমান অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে কুমারখালী থানায় মামলা করেন। রুবেল স্থানীয় দৈনিক কুষ্টিয়ার খবর পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও দৈনিক আমাদের নতুন সময় পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি ছিলেন।
রুবেল হত্যা মামলার কী অবস্থা, তা জানতে রুবেলের পরিবার ও পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মামলার বাদী মিজানুর রহমান বলেন, ‘বিচার আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। নৌ পুলিশের কোনো সহযোগিতা নেই। চার্জশিটও দেয়নি।’
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় লক্ষ্মীকুণ্ডা নৌ থানার এসআই শামীম হোসেন বলেন, ‘মামলাটি এখনো তদন্তাধীন। অগ্রগতি ও অভিযোগপত্রের ব্যাপারে নতুন স্যার যোগদান করে ব্যবস্থা নেবেন।’
সংবাদ সংগ্রহে হামলা
২০২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়নের সিরাজনগরে চাচাকে বাবা সাজিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অ্যাডমিন ক্যাডারে চাকরির সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের কুষ্টিয়ার স্টাফ রিপোর্টার শরীফ বিশ্বাস, ক্যামেরাপারসন সুমন ও স্থানীয় সাংবাদিক বিদ্যুৎ খন্দকার। এ ঘটনায় শরীফ দৌলতপুর থানায় মামলা করেন। দেড় বছরেও এ মামলার চার্জশিট দেয়নি পুলিশ।
সাংবাদিক শরীফ বিশ্বাস বলেন, ‘মামলা করা হলেও নানা চাপে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। পুলিশ চার্জশিট পর্যন্ত দেইনি। হতাশা নিয়ে আর যোগাযোগ করিনি।’
২০১১ সালে শিলাইদহের রবীন্দ্র কুঠিবাড়িতে স্থাপনা ও রাস্তা নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ সংগ্রহ করার সময় ঠিকাদারের লোকজনের হামলায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন প্রথম আলোর সাংবাদিক তৌহিদী হাসান, একুশে টিভির জহুরুল ইসলাম ও আরটিভির শেখ হাসান বেলাল। এ ঘটনায় মামলা করা হলেও ঠিকাদার ওই আওয়ামী লীগ নেতার চাপে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন জহুরুল।
২০১৪ সালে প্রথম আলোর সাংবাদিক তৌহিদী হাসান ও চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের সাংবাদিক শরীফ বিশ্বাস কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের বেধড়ক মারধর করেন। সে সময় মামলা করতে দেওয়া হয়নি ভুক্তভোগী দুই সাংবাদিককে। বরং ঘটনা মীমাংসা করে নিতে উল্টো চাপ দেওয়া হয়েছিল।
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদী হাসান বলেন, শিলাইদহের ঘটনায় মামলা তুলে নেওয়ার চাপ ছিল আর সরকারি কলেজের ঘটনায় মামলা করতেই দেওয়া হয়নি। তিনি মনে করেন, সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে। যেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেওয়া হচ্ছে না।
২০১২ সালে কুষ্টিয়া শহরতলির একটি মাদ্রাসায় ছাত্রকে যৌন নির্যাতনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক মিলনউল্লাহ ও ক্যামেরাপারসন নিয়ামুল হক। এ ঘটনায় মিলনউল্লাহ বাদী হয়ে মামলা করলেও পরে তিনি মামলা থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। মিলনউল্লাহ বলেন, ‘মামলা নিয়ে অন্য রাজনীতি শুরু হয়েছিল। সেই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে চাপও ছিল। তাই পরে বাধ্য হয়ে আমি সরে এসেছি।’
এদিকে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ সংগ্রহকালে হামলা ও বেধড়ক মারধরের শিকার হয়েছেন স্থানীয় দৈনিক খবরওয়ালা পত্রিকার চিত্র সাংবাদিক ইমরান হোসেন। পরে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মামলা করেছেন ইমরান।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুষ্টিয়া জেলার শাখার সদস্য মিজানুর রহমান লাকী বলেন, মূলত ওপরে ওপরে সম্পর্ক দেখালেও সাংবাদিকদের পাশে কেউ থাকতে চায় না। কারণ দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা আর পুলিশ প্রশাসন—এরা সবাই সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ মনে করে। যে কারণে কোনো সাংবাদিক বিপদে পড়লে তারাই আবার প্রভাব বিস্তার করে। তা ছাড়া রাজনৈতিক ও প্রশাসনের চাপেও বাধ্য হতে হয় মামলা গুটিয়ে নিতে।
কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি আল মামুন সাগর বলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে হামলাকারীরা সব সময় বহাল তবিয়তে থাকে। পুলিশ দুদিন পর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পরে কোনো সহযোগিতা না পেয়ে হামলার শিকার সাংবাদিকও চাপে পড়ে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন। এ কারণে ওই মামলাগুলো আর আলোর মুখ দেখে না। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আইনের কঠোর প্রয়োগ। সর্বশেষ গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে।’
কুষ্টিয়ার অবসরপ্রাপ্ত সহকারী পুলিশ সুপার (সদর দপ্তর) মো. শহিদুল্লাহ মনে করেন, মামলায় প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর অভাব, ক্রাইম সিনের আলামত আমজনতার অসচেতনতার কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া এবং প্রথম দিকে সাংবাদিকেরা রুবেলের হত্যাকাণ্ড নিয়ে হইচই করলেও পরে হঠাৎ নীরব হয়ে যাওয়াই মামলাটি তদন্তাধীন থাকার কারণ হতে পারে।
ক্রাইম জোন ২৪