ইরানি নকশার ড্রোন হয়ে গেছে রাশিয়ার, ক্ষোভ বাড়ছে তেহরানে


ইরানের শাহেদ ড্রোনের নকশা ব্যবহার করে এই ড্রোন উৎপাদনের জন্য বিশাল এক কারখানা নির্মাণ করেছে রাশিয়া। তাতারস্তান অঞ্চলের আলাবুগা শিল্প এলাকায় অবস্থিত এই কারখানাটি বর্তমানে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ড্রোন উৎপাদন কেন্দ্র। কারখানাটির সিইও তিমুর শাগিভালেভ জানিয়েছেন, ড্রোনটি তৈরির প্রায় সব উপাদানই এখন স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে—অ্যালুমিনিয়াম বার থেকে ইঞ্জিন, চিপ থেকে মাইক্রোইলেকট্রনিক্স, আর কার্বন ফাইবার ও ফাইবারগ্লাস থেকে ড্রোনের মূল কাঠামো। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ড্রোনগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ উৎপাদন প্রক্রিয়া এখন রাশিয়ার ভেতরেই সম্পন্ন হচ্ছে।
স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, আলাবুগা কারখানাটি দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে নতুন উৎপাদন ভবন, শ্রমিকদের থাকার জন্য ডরমিটরি, যা উৎপাদন ক্ষমতা বহুগুণ বাড়াতে সক্ষম করবে। ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়া এখন এই আপডেটেড ও যুদ্ধ-পরীক্ষিত শাহেদ-১৩৬ ড্রোন অন্য দেশেও রপ্তানি করতে পারে, এমনকি এই ড্রোনের নিজের দেশ ইরানেও।
তবে পশ্চিমা গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে শুক্রবার (৮ আগস্ট) সিএনএন জানিয়েছে, ড্রোনগুলোর উৎপাদন পুরোপুরিভাবে রুশীকরণ হওয়া ইরানকে প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। আবার রাশিয়ার কাছ থেকে প্রত্যাশিত প্রতিদান না পেয়ে তেহরানের মধ্যে ক্ষোভও বাড়ছে। বিশেষ করে, সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের সংঘাতের সময় রাশিয়ার নরম প্রতিক্রিয়া ইরানকে হতাশ করেছে। তেহরানভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বিশ্লেষক আলি আকবর দারেইনি মনে করেন, ইরান প্রত্যাশা করেছিল রাশিয়া আরও সক্রিয় ভূমিকা নেবে। অন্তত অস্ত্র, প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা সহায়তা বাড়াবে।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা অবশ্য মত দিয়েছেন, রাশিয়া ও ইরানের সম্পর্ক মূলত স্বার্থনির্ভর ও লেনদেনভিত্তিক। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সালে ইরানি শাহেদ ড্রোন আমদানি শুরু করে রাশিয়া এবং ২০২৩ সালের শুরুর দিকে ১.৭৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে দেশেই উৎপাদন শুরু করে।
চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাশিয়ার কারখানায় ৬ হাজার ড্রোন উৎপাদনের যে পরিকল্পনা ছিল, তা প্রায় এক বছর আগেই পূরণ হয়ে গেছে। বর্তমানে ওই কারখানায় প্রতি মাসেই সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি ড্রোন তৈরি হচ্ছে। তা ছাড়া আগের তুলনায় এই ড্রোনের উৎপাদন খরচ অনেক কমে গেছে। ২০২২ সালে একেকটি ড্রোন তৈরি করতে যেখানে খরচ ছিল প্রায় দুই লাখ ডলার, এখন তা নেমে এসেছে ৭০ হাজার ডলারে।
ইউক্রেনের তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়া এই ড্রোনটির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটিয়েছে। এর যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করেছে, দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারি ও বড় আকারের ওয়ারহেড যুক্ত হয়েছে। এর ফলে ড্রোনগুলো আরও মারাত্মক এবং প্রতিরোধ করা কঠিন করে তুলেছে। এর ফলে ইরান ধীরে ধীরে নিজেদের পণ্যের ওপরই চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে দুই দেশের মধ্যে কিছু আর্থিক লেনদেনও আটকে গেছে, যা ইরানের অসন্তোষ বাড়িয়েছে।
ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পর ইরান নিজেকে পুনর্গঠন ও ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাগুলো মেরামতে মনোযোগ দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আলাবুগার বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতা ইরানকে কিছু আপডেটেড শাহেদ ড্রোন ফেরত পেতে সহায়তা করতে পারে। ওপেন-সোর্স ফ্লাইট ডেটায় দেখা গেছে, গত ১১ জুলাই মস্কো থেকে তেহরানে একটি রুশ সামরিক পরিবহন বিমান উড়ে যায়। ইরানি গণমাধ্যমের দাবি অনুযায়ী, ওই বিমানে করে রুশ এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের চূড়ান্ত উপাদান বহন করা হয়েছিল।
বিশ্লেষক দারেইনির মতে, বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন আছে। তবে শেষ পর্যন্ত ইরান এই অংশীদারত্ব থেকে উপকৃত হবে। হতে পারে তা সামরিক সরঞ্জাম, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বা প্রযুক্তিগত সহায়তার ক্ষেত্রে।