আখাউড়া ইমিগ্রেশনে টাকা দিলে সব হয়


ভারতের আগরতলার বাসিন্দা নমিতা বণিক। গত ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশে আসেন। তাঁর ভিসায় টানা ৬০ দিনের বেশি বাংলাদেশে অবস্থান করার সুযোগ ছিল। তবে তিনি ১ মাস ২০ দিন অবৈধভাবে বাংলাদেশে ছিলেন। দেশে ফেরার সময় আইনি পদক্ষেপ এড়াতে আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে ওসি মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার ও এসআই আব্দুর রহিমকে ৯৫ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন নমিতা।
আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে কম্পিউটার ডেটা এন্ট্রিতে দেখা যায়, ২ আগস্ট নমিতা আগরতলায় ফিরে যান। তবে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সূত্র জানিয়েছে, দেশে ফেরার এই সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে সেখানকার এসআই আব্দুর রহিমের আইডি থেকে।
এ তো গেল একটি ঘটনা। বন্দরের সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, ঘুষ লেনদেনের ঘটনা প্রায়শই এবং প্রকাশ্যে ঘটছে। এমনকি ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশিদের কাছ থেকেও নেওয়া হচ্ছে ঘুষ। আর তা দিতে না পারলে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। আর সিন্ডিকেটের হোতা ওসি নিজেই। তাঁর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন আরও কয়েকজন পুলিশসহ, ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে গত ২২ জুলাই হয়রানির শিকার হয়েছেন কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার দুই বাসিন্দা রুবেল মিয়াজি ও মোহাম্মদ ফেরদৌস। চিকিৎসা নিতে ভারতে যাওয়ার জন্য আখাউড়া ইমিগ্রেশনে গিয়েছিলেন তাঁরা। মোহাম্মদ ফেরদৌস বলেন, ‘ওই সময় দায়িত্বে থাকা পুলিশের এসআই আব্দুর রহিম তাঁদের বলেন, তোমরা দিল্লি অ্যাম্বাসি ফেস করতে যাচ্ছ, আমি সব বুঝি। আমার চোখ ফাঁকি দিতে পারবা না।’ এরপর তিনি তাঁদের কাছে ৪০ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় আব্দুর রহিম ভারতীয় ইমিগ্রেশনে কল করে তাঁদের পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে দেন। পরে তাঁরা আগরতলায় পৌঁছালে সেখানকার ইমিগ্রেশন তাদের জানায়, আগে থেকেই তাঁদের তথ্য পাঠানো হয়েছে, তাই তাঁদের এন্ট্রি রিফিউজ করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। আখাউড়া ইমিগ্রেশনে ফিরে আসার পর আব্দুর রহিম তাঁদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং পুনরায় মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। শেষ পর্যন্ত ৫ হাজার টাকা দিয়ে তাঁরা ছাড় পান।’
এ বিষয়ে আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশনের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি যোগদানের পর থেকে সবকিছু নিয়ম অনুযায়ী হচ্ছে। কোনো যাত্রী হয়রানির শিকার হচ্ছেন না।’
তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৩ জুলাই সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে চারজন মেডিকেল ভিসাধারী ভারতে যাওয়ার জন্য আখাউড়া ইমিগ্রেশনে ৮০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন। কনস্টেবল দেলোয়ার হোসেন নিজেই তাঁদের পাসপোর্ট নিয়ে পুলিশের ব্যারাক রুমে গিয়ে এসআই আব্দুর রহিমের হাতে তুলে দেন এবং কাউন্টারে কোনো লাইনে না দাঁড়িয়েই তাঁদের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। টাকা লেনদেন হয়েছে যাত্রীছাউনিতে বসে। ইমিগ্রেশনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে মিলেছে সেই দৃশ্য।
সম্প্রতি ঢাকা কাস্টম হাউস কর্তৃক নিষিদ্ধঘোষিত এক যাত্রীকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আখাউড়া ইমিগ্রেশন পার করিয়ে দেন দেলোয়ার। অভিযোগ রয়েছে, তিনি উপপরিদর্শক হাবিবের আইডি ব্যবহার করে ওই যাত্রীর পাসপোর্টে সিল দেন। পরে বেনাপোলে তিনি ধরা পড়লে বিষয়টি স্পেশাল ব্রাঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছায়।
তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার এহতেশামুল হক বলেন, ‘যাত্রী হয়রানি এবং ঘুষ নেওয়ার এই রকম অভিযোগের বিষয়টি আমার জানা নেই। ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ অনুসন্ধান করে পাওয়া গেলে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নিয়ম অনুযায়ী, কনস্টেবলের কাজ শুধু যাত্রীদের শৃঙ্খলা রক্ষা এবং সহায়তা দেওয়া। কিন্তু কনস্টেবল দেলোয়ার হোসেন তিন বছর ধরে নিয়মিত ইমিগ্রেশন ডেস্কে বসে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি চোরাচালানি চক্র এবং ‘লাগেজ পার্টিদের’ সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে সুবিধা নিচ্ছেন। কনস্টেবল দেলোয়ার ও ইমিগ্রেশনের ওসি আব্দুস সাত্তার একই উপজেলার (মুরাদনগর) বাসিন্দা হওয়ায় তাঁদের প্রভাব বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এসআই আব্দুর রহিম।