শিরোনাম

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলেন আরও দুইজন

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলেন আরও দুইজন

গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সারা দেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় বুধবার (৬ আগস্ট) আরও দুজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ তাঁদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।

বুধবার সাক্ষ্য দেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) সাবেক শিক্ষার্থী রিনা মুর্মু ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির রংপুর প্রতিনিধি এ কে এম মঈনুল হক। জবানবন্দি শেষে তাঁদের জেরা করেন পলাতক শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এই মামলার অপর আসামি ও রাজসাক্ষী পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়।

পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১৭ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়েছে। এ নিয়ে এই মামলায় পাঁচজন সাক্ষ্য দিলেন। এর আগে ৩ ও ৪ আগস্ট সাক্ষ্য দেন যথাক্রমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত গাড়িচালক খোকন চন্দ্র বর্মণ, আহত ছাত্র আব্দুল্লাহ আল ইমরান ও পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো পারভীন।

গতকাল ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হয়ে সোয়া ৩টা পর্যন্ত চলে। মাঝে বেলা ১টা ১০ মিনিট থেকে ২টা পর্যন্ত বিরতি দেওয়া হয়। কার্যক্রমের শুরুতে বিচারকেরা এজলাসে বসলে প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম বলেন, ৫ আগস্ট দেশ ফ্যাসিস্টমুক্ত হয়েছিল। তাই দিনটি সারা দেশে উৎসবমুখরভাবে পালিত হয়েছে।

গাজী এম এইচ তামিমের বক্তব্যের পর জবানবন্দি দেন বেরোবি থেকে গত বছর মাস্টার্স শেষ করা সাঁওতাল সম্প্রদায়ের রিনা মুর্মু। তিনি বলেন, গত বছর আন্দোলনের সময় তিনি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন। কোটা সংস্কারের যৌক্তিক দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের অংশ হিসেবে রংপুরেও ১ থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলে। ১৪ জুলাই পুলিশি বাধা সত্ত্বেও তাঁরা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন। সেদিন সন্ধ্যার দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে সম্বোধন করলে এর প্রতিবাদে সারা দেশ ফুঁসে ওঠে। রংপুরেও প্রতিবাদে রাতে মেয়েরা হল থেকে বেরিয়ে প্রতিবাদ মিছিল করেন। ওই রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ আক্রমণ করে। এর প্রতিবাদে ১৫ জুলাই বিকেলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটে প্রতিবাদ সমাবেশ ছিল। তিনি যথাসময়ে সেখানে গিয়ে দেখেন, ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত) একই স্থানে পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, শামীম, বাবুলদের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা ছিলেন। তাঁদের হাতে রামদা, লাঠি, রডসহ দেশীয় অস্ত্র ছিল। এ কারণে তাঁরা একত্র হতে পারেননি। সরদারপাড়া থেকে একটি মিছিল আসার সময় হামলায় কয়েকজন আহত হন। এতে সমাবেশ হয়নি।

রিনা মুর্মু জবানবন্দিতে আরও বলেন, ১৬ জুলাই তাঁরা আন্দোলনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট এবং লালবাগে দুটি স্থান নির্ধারণ করেন। সকাল ১০টার দিকে জিলা স্কুলের সামনে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা একত্র হয়ে মিছিল নিয়ে প্রেসক্লাবে এলে তিনি যোগ দেন। তাঁরা মিছিল নিয়ে চারতলা মোড়ে যাওয়ার পথে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। সেখানে বেরোবি ও কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটে একত্র হন। আগে থেকে গেটে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লোকজন অবস্থান করছিলেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে গেলে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে হঠাৎ পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। মিছিলে আরমান, ইমরান, আবু সাঈদ, সাবিনা ইয়াসমিন, রাইসুলসহ ৫-৬ হাজার শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। তিনি ১ নম্বর গেটের বিপরীতে চায়ের দোকানে আশ্রয় নেন।

আবু সাঈদ প্রসঙ্গে রিনা মুর্মু বলেন, তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে আবু সাঈদকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ লাঠি দিয়ে মারধর করে। আবু সাঈদ রাস্তার ডিভাইডারের একটু সামনে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ান। ১ নম্বর গেটে অবস্থানরত দুজন পুলিশ সদস্য আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে গুলি করেন। আবু সাঈদ পড়ে যান। সহযোদ্ধা আয়ান গিয়ে আবু সাঈদকে ওঠান। পরে আরও কয়েকজন গিয়ে তাঁকে পার্কের মোড়ের দিকে নিয়ে যান। পরে তিনি জানতে পারেন, যাঁরা গুলি করেছেন, তাঁরা আমির আলী ও সুজন চন্দ্র। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে তিনি জানতে পারেন, আবু সাঈদ মারা গেছেন।

রিনা এই হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনা, বেরোবি প্রশাসন, যাঁরা সরাসরি গুলি করেছেন, রংপুর মহানগর পুলিশের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন এবং ছাত্রলীগকে দায়ী করে তাঁদের বিচার চান। জবানবন্দি শেষে তাঁকে জেরা করেন আইনজীবী আমির হোসেন।

এরপর জবানবন্দি দেন এ কে এম মঈনুল হক। তিনি বলেন, ১৬ জুলাই বেরোবির ১ নম্বর গেটের সামনে পার্কের মোড় এলাকায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন। রংপুর প্রেসক্লাব এলাকা থেকে শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে গেলে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং সরকারি দলের সমর্থকেরা বাধা দেন। পুলিশের আশপাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিলেন। আন্দোলনকারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় এবং একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও শটগানের গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। তখন এনটিভিতে বেলা ২টার খবর শুরু হলে তাঁকে লাইভে সম্পৃক্ত হতে বলা হয়। তিনি লাইভে যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি তুলে ধরেন। ২টা ১৭ মিনিটের দিকে ১ নম্বর গেটের সামনে রোড ডিভাইডারের একটি ছোট কাটা অংশ দিয়ে এসে এক যুবক দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে দাঁড়ান। সেখান থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরত্বে থাকা পুলিশ তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে। এই দৃশ্য এনটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার চলছিল। পুলিশের গুলি যুবকের বুক ও পেটে লাগে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি কয়েক পা পিছিয়ে যান এবং বসে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। তাঁর কয়েকজন সঙ্গী তাঁকে তুলে পার্কের মোড়ের দিকে নিয়ে যান। তাঁকে যে পুলিশ সদস্যরা গুলি করছিলেন, তাঁদেরও লাইভে দেখানো হয়।

মঈনুল হক বলেন, পরে সহকর্মীদের মাধ্যমে জানতে পারেন, গুলিবিদ্ধ ওই যুবককে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারেন, তাঁর নাম আবু সাঈদ এবং তিনি বেরোবির ইংরেজি বিভাগের ১২ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। বেলা ৩টার দিকে আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর জানেন।

মঈনুল হকের কাছে থাকা ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ট্রাইব্যুনালে দেখানো হয়। ফুটেজে আবু সাঈদকে গুলি করার পর নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য রয়েছে।



আরও দেখান

সম্পর্কিত খবর

Back to top button