যার কথায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন ট্রাম্প


দিমিত্রি মেদভেদেভের রাজনৈতিক যাত্রা এক অসাধারণ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে ঘটেছে। ২০০৮ সালে যখন তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন, তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের বহু সমস্যার সমাধান নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যৌথ সদিচ্ছার ওপর।’ কিন্তু সেদিনের সেই ‘সহযোগিতার কণ্ঠ’ আজ পরিণত হয়েছে আগ্রাসী ও উত্তেজক বক্তৃতায়। দিমিত্রির এসব বক্তৃতায় যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এতটাই খেপেছেন যে, তিনি দুটি পারমাণবিক সাবমেরিন রাশিয়ার জলসীমার কাছাকাছি পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
রোববার সিএনএন জানিয়েছে, বর্তমানে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের উপ-চেয়ারম্যানের আসনে বসা মেদভেদেভের হাতে কার্যকর কোনো শাসনক্ষমতা নেই। তবুও তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তপ্ত ও প্ররোচনামূলক বক্তব্য পশ্চিমা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন নিষেধাজ্ঞার হুমকির প্রতিক্রিয়ায় মেদভেদেভ বলেন—ট্রাম্প যেন ‘দ্য ওয়াকিং ডেড’ টিভি সিরিজের মতো ভয়াবহ পরিণতির কথা ভাবেন। রাশিয়ার স্বয়ংক্রিয় পারমাণবিক হামলার সক্ষমতার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন দিমিত্রি।
এই বাগ্যুদ্ধ এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন ট্রাম্প পুতিনকে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বলেছেন। শান্তিচুক্তি না হলে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছেন তিনি। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই হুমকি আমলে নেবে না ক্রেমলিন।
দিমিত্রি মেদভেদেভ এক সময় ছিলেন আধুনিকতা ও সংস্কারের প্রতীক। একজন আইনজ্ঞ হিসেবে তাঁর কোনো গোয়েন্দা সংস্থার পটভূমি ছিল না—যা পুতিনের ছিল। ইন্টারনেটপ্রেমী, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান গ্রহণকারী মেদভেদেভের সেই চিত্র আজ সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ২০১২ সালে পুতিনের ফিরে আসার পথ তৈরি করে দিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর থেকেই তিনি ধীরে ধীরে একজন জাতীয়তাবাদী ও আগ্রাসী বক্তায় পরিণত হন।
২০০৯ সালে সিএনএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মেদভেদেভ বলেছিলেন, ‘আমরা পশ্চিমাদের সঙ্গে সব দিক থেকে সুসম্পর্ক চাই।’ আর ২০২৫ সালে তিনি বলছেন, ‘ট্রাম্প যদি মনে করে পুতিন আগুন নিয়ে খেলছেন, তবে এটা বোঝা উচিত—তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধই হতে পারে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়।’
প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নেওয়া মেদভেদেভ পরে নিজেই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন। রাশিয়ার প্রয়াত বিরোধীদলীয় নেতা আলেক্সেই নাভালনির নেতৃত্বাধীন একটি অনুসন্ধানে দেখা যায়—দিমিত্রি বিলাসবহুল সম্পত্তি, প্রমোদতরী এবং দ্রাক্ষাক্ষেত্রের মালিক। তবে তাঁর মুখপাত্র এসব অভিযোগ ‘প্রচারমূলক নাটক’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন দিমিত্রি। সেই সময়টিতেই পুতিন সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করছিলেন। আর দিমিত্রি রাশিয়ার যুদ্ধঘেঁষা প্রচারণার এক মুখপাত্রে পরিণত হন। ইউক্রেনের নেতৃত্বকে তিনি ‘বোতলের ভেতরে জন্মানো তেলাপোকা’ বলে কটূক্তি করেন। ট্রাম্প ও জেলেনস্কিকে ‘মাপেট’ বলেও উপহাস করেন।
দিমিত্রি মেদভেদেভের টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রায় ১৭ লাখ অনুসারী এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। তাঁর ভাষায় প্রায় সময়ই নাৎসিবাদের প্রসঙ্গ আনা হয়। যেমন তিনি সম্প্রতি জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ ম্যার্ৎসকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ভেবে দেখো, নাৎসি!’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মেদভেদেভের এই সব কথাবার্তা ‘নাটকীয়’ এবং এটি একটি নির্ধারিত কৌশলের অংশ, যার লক্ষ্য পশ্চিমাদের ভয় পাইয়ে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। ষোলো বছর আগে তিনি ছিলেন আশা জাগানো নেতা, আর আজ তিনি রাজনৈতিক নাটকের আগুনঝরা বক্তা।